দে পাড়ার মেলা। সেকালের চিত্র চরিত্র

দে পাড়া অতি ক্ষুদ্র গ্রাম, আমরা একেবারে মন্দিরের নিকট উপস্থিত হইলাম, মন্দিরের নিকট এক মাইলের মধ্যে কোনোদিকে বসতি নাই। চতুর্দিকে চষা জমি, তবে মন্দিরের চতুর্দিক জঙ্গলপূর্ণ, অশ্বত্থ, বট, তেঁতুল, বেল প্রভৃতি বড়ো বড়ো গাছেই এই জঙ্গল হইয়াছে; মন্দিরটি সমতল ভূমিখণ্ডের উপর নহে, একটি উচ্চঢিবির উপর, মন্দিরটি ক্ষুদ্র।

ক্রমে যতই বেলা বাড়িতে লাগিল, চতুর্দিকস্থ নিকটবর্তী গ্রামসমূহ হইতে জন সমাবেশ হইতে লাগিল। আমরা একটি বৃক্ষতলে বিশ্রাম করিবার জন্য বসিলাম; কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের পর নিকটস্থ একটি সরোবরে স্নান করিয়া আসিলাম, তাহাতে জল যদিও অধিক ছিল না, কিন্তু তাহা শীতল ও পরিষ্কার। স্নান শেষ করিয়া কিঞ্চিৎ জলযোগ করা গেল, তাহার পর সেই জঙ্গলের মধ্যে ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিতে লাগিলাম।

বড়ো বড়ো বৃক্ষ, তাহার তলদেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যাত্রীগণের বিশ্রাম স্থান। বৃক্ষতলেই নানাবিধ দ্রব্য বিক্রয়ার্থ আনীত দেখিতে পাইলাম আম, লিচু, তালের শাঁস, বঁইচি প্রভৃতি ফল স্তূপাকারে রহিয়াছে, নানাবিধ মিষ্টান্ন দ্রব্যও দেখা গেল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেগুলি অখাদ্য। বেলা দুইপ্রহরের সময় তরমুজ, খরমুজ প্রভৃতি আরও অনেক ফল চারি-পাঁচ ক্রোশদূর হইতে বিক্রিত হইতে আসিল; কৃষ্ণনগর হইতেও দু-পাঁচ জন দোকানদার তাস, পট, পটকা, কাচের গ্লাস, মাটির পুতুল প্রভৃতি বিক্রয়ার্থ আনিয়া ছিল। আমরা মধ্যাহ্নে মন্দিরের ভিতর ঠাকুর দেখিতে চলিলাম।

দেখিলাম কলিকাতার বটতলায় এক পয়সা দামে যে দশ অবতারের ছবির কাগজ বিক্রয় হয়, তাহাতে যেমন নৃসিংহদেবের মূর্তি সেইরূপ এক মূর্তি। নৃসিংহদেব কোনো সিংহাসনের উপর অবস্থিত নহেন, মৃত্তিকার উপরই অর্থোপবিষ্টভাবে অবস্থান করিতেছেন, ক্রোড়ে মৃত হিরণ্যকশিপু, দেখিতে কৃষ্ণবর্ণ, বোধ হয়। পাষাণময়।

মন্দিরের পুরোহিত বড়ো ভদ্র লোক বলিয়া বোধ হইল। আমাদের প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহ প্রকাশ করিলেন এই মন্দির সম্বন্ধে অনেকগুলি কথা বলিলেন। নৃসিংহদেবের অনেক মাহাত্ম্যের কথা শুনিতে পাইলাম।

কিছু পরে ক্ষুধার উদ্রেক হওয়াতে মন্দিরের বাইরে কিয়দ্দূর আসিয়াই আমরা বিস্ময় নেত্রে দেখিলাম একটি বিশ্ববৃদ্ধে শত শত ইষ্টক খণ্ড রজ্জুবদ্ধ রহিয়াছে; প্রথমে মনে করিলাম রাখালের দল এই কাজ করিয়াছে, নতুবা আর এমন নিষ্কর্মা লোক কে আছে যে গাছে ঢেলা বাঁধিয়া রাখিবে? অদূরে এক বৃদ্ধকে দেখিতে পাইয়া তাহাকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম; সে ব্যক্তি উত্তর দিল যে পুত্রলাভের মানসে লোকে এই সমস্ত ইষ্টক খণ্ড বাঁধিয়া রাখিয়া যায়, ঠাকুর তাহাদের প্রতি সদয় হইয়া পুত্ররত্ন দান করেন তাহাদের লাভ বংশ বৃদ্ধি আর ঠাকুরের লাভ পায়সারের ভোগ। ক্ষুধানলে সে সময় আমাদের উদর দগ্ধ হইতেছিল—বিশেষত উপস্থিত বন্ধুবর্গের মধ্যে কাহারও পুত্রের প্রয়োজন বোধ হয় নাই সুতরাং জনসাধারণের প্রতি ঠাকুরের এই অসীম অনুগ্রহের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করিয়া আমার দ্রুতপদে নির্দিষ্ট বৃক্ষের পাদদেশে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

এ-সময় রন্ধনকার্য করা বিশেষ সুবিধাজনক নহে বুঝিয়া আমরা চিপিটক ও দধিতে ক্ষুধা নিবৃত্তি করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, কিন্তু ভোজন ব্যাপার বড়ো সুবিধাজনক হইল না। মোটা চিড়া, জোলো দই আর মান্ধাতার আমলের সন্দেশ এই তিন দ্রব্যের একত্র সম্মিলনে যে কি উপাদেয় দ্রব্য প্রস্তুত হয় তাহা আশা করি আমাদের পাঠক-পাঠিকাগণ সকলেই অনুমান করিয়া লইতে সক্ষম, সুতরাং সে সম্বন্ধে এখানেই পূর্ণচ্ছেদ।

আহারাদি সমাপন করিয়া আমরা বিশ্রাম করিতে বসিব, এমন সময় মন্দিরের নিকট অনেক লোকের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। ব্যাপার কী দেখিবার জন্য সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম নবদ্বীপ হইতে একটি ভদ্রলোক সপরিবারে আত্মীয়স্বজন লইয়া তাহার নবকুমারের অন্নপ্রাশন দিতে মন্দিরে আসিয়াছেন। আমাদের পূর্বকথিত বিশ্ব শাখায় ইষ্টক খণ্ড বাঁধিয়া রাখাতে নৃসিংহদেবের প্রসাদে। এই ভদ্রলোকটি পুত্রমুখ দর্শন করিয়াছেন, সেই জন্য কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ তিনি নৃসিংহদেবের নিকট পায়সান্ন ভোগ দিবেন এবং দেবতার প্রসাদে তাঁহার পুত্রের অন্নপ্রাশন হইবে। দেখিলাম অনেকগুলি গোপ দুগ্ধ ভার লইয়া উপস্থিত হইয়াছে, একটি বৃক্ষতলে কতকগুলি উনান খনন করা হইল, পায়সান্ন প্রস্তুত হইলে যথা ক্রমে অন্নপ্রাশন ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গেল; আহুত-অনাহূত অনেকেই নৃসিংহদেবের প্রসাদ পাইলেন। শুনিলাম এইরূপ অন্নপ্রাশন কোনো মাসেই ফাঁক যায় না।
এইবার আমরা আমাদের বৃক্ষতলে আসিয়া শয়ন করিলাম। এখন বেলা দুইটা বাজিয়া গিয়াছে, ভয়ানক গরম, কিন্তু বৃক্ষতল কথঞ্চিৎ শীতল। সূর্যদেব পশ্চিমে ঈষৎ হেলিয়া পড়িয়াছেন— অঁহার দুই একটি রশ্মি বৃক্ষপত্রের মধ্য দিয়া আমাদের কাছে আসিয়া পড়িয়াছে একটি ঘুঘু আমাদের অদৃশ্য থাকিয়া বৃক্ষপত্রে শরীর আচ্ছাদিত করিয়া ডাকিতেছে 'ঘু ঘু ঘু'। নিকটস্থ একটি তেঁতুলের ডালে এক পাল হনুমান, তাহাদের অধিকৃত এই বিজন প্রদেশ আজ কোলাহলপূর্ণ হইয়াছে বলিয়া তাহাদের মনে কিছু ভাবাত্তর উপস্থিত হইয়াছে, তাহারা লাঙ্গুল আস্ফালন করিয়া কখনও-বা ছাপান্ন রকম মুখভঙ্গিতে দত্তবিকাশপূর্বক চিঁ চিঁ শব্দ করিয়া আপনাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করিতেছে, কখনও বৃক্ষের এক শাখা হইতে দূরস্থিত শাখান্তরে লম্ফ দিয়া তাঁহাদের আদিপুরুষ বীরপ্রবর পবনাত্মজের স্মৃতি দর্শকদিগের মনোমধ্যে জাগরিত করিয়া দিতেছে।


দে পাড়ার মেলা

দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত 
সেকালের চিত্র চরিত্র

সংকলন, সম্পাদনা, টীকা ও ভূমিকা : শতঞ্জীব রাহা

মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।