পাথারে। সেকালের চিত্র চরিত্র

ভৈরব প্রাচীন নদী। কিন্তু এমন বাঁক বোধ হয় বঙ্গের কোনো নদীতে নাই। নদীপথে যাইতে যাইতে নদীকূলে দুই একটি বটগাছ দেখিতে পাওয়া যায়, নদীর বাঁক ঘুরিয়া সেই বটতলায় আসিতে সমস্ত দিন লাগে, এরূপও দেখা গিয়াছে। একে মূল নদী পদ্মা জলাভাবে এই শাখায় যথেষ্ট জলধারা ঢালিয়া দিতে পারে না, তাহার ওপর এই রকম বাঁক, সুতরাং বৎসরের অন্যান্য ঋতুতে নদীতে জল থাকে না। কোথাও এক গলা, কোথাও এক বুক জল থাকে, তাহাও শৈবালদাম-সমাচ্ছন্ন। স্রোতের অভাবে নদীর অধিকাংশ স্থলই মজিয়া গিয়াছে। কৃষকেরা জলের ধার পর্যন্ত হল-চালনা করিয়া শস্য বপন করে, সেই জন্য নদী আরও অধিক ভরাট হইয়া উঠিয়াছে ; তাই শীর্ণকায়া অগভীর বক্রগামিনী স্রোতহীনা নদীর অবস্থা দেখিলে নিকটবর্তী পল্লীবাসীগণের চক্ষুতে জল আসে। দুই শত মণ বোঝাই নৌকাও নদীপথে চলিতে পারে না, স্থূল শৈবাল বা টোপা পানার স্তূপ ভেদ করিয়া পল্লীবাসীগণ নদীপথে নৌকারোহণে গ্রামান্তরেও যাইতে পারে না; শৈবালদলে দাঁড় বাধিয়া যায়, পালেও নৌকা চলে না। বন্ধনদী ম্যালেরিয়া ও মশকের আশ্রয়দুর্গে পরিণত হইয়াছে। বর্ষাকালে কোনো কোনো বার নদীতে অল্প জল আসে, তখন নদীবক্ষ যৎসামান্য স্ফীত হইয়া ওঠে মাত্র, তাহাতে নদীবক্ষঃসঞ্চিত স্থূল শৈবালরাশিও ভাসিয়া যাইতে পারে না।

কিন্তু পাঁচ-সাত বৎসর অন্তর এক একবার নদীতে বান আসে। পদ্মার উভয় কূল প্লাবিত করিয়া বর্ষার জলরাশি যেবার মাঠে প্রবেশ করে, সেইবার সেই বিপুল জলরাশি শত শত বিল, ঝিল পয়োনালা ভাসাইয়া, খালের বাঁধগুলি ভাঙিয়া ভৈরবে প্রবেশ করে ; শত দিক হইতে শত ধারায় জল আসিয়া ভৈরবের সংকীর্ণ বক্ষ পূর্ণ করে পদ্মা, ভাগীরথী, জলঙ্গী, চূর্ণী—সকল নদীর সহিত ভৈরবের মিলন হয় এবং এই সকল নদীর উচ্ছ্বসিত সলিলরাশি ভৈরবের শোভা ও সম্পদ পরিবর্ধিত করে।

এবার সেই অবস্থা। বোট চলিতে লাগিল। দেখিলাম, নদীজল উভয় কূল প্লাবিত করিয়া নদী তীরবর্তী শস্যক্ষেত্রগুলি ডুবাইয়া পল্লীমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। বৎসরের অন্যান্য সময় পারঘাটার যে বটবৃক্ষমূলে গরুর গাড়ি রাখিয়া গাড়োয়ানেরা ‘তিউড়ি' খুঁড়িয়া ভাত খাইত, সেখানে এখন এক বাঁশ জল! বর্ষার জলস্রোত বটগাছের কাণ্ডেও বয়া’গুলিতে বাধিয়া কল কল ছল ছল শব্দে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হইতেছে। ঘাট-মাঝিদের চালাঘরখানি একগলা জলে দাঁড়াইয়া আছে। সৰ্প, ভেক ও ইন্দুর তাহার চালে আশ্রয় লইয়াছে—সকলেরই সমান বিপদ, তাই তাহারা খাদ্য-খাদক সম্বন্ধ ভুলিয়া গিয়াছে!

প্রভাতে সুখস্পর্শ শীতল সমীরণ প্রবাহিত হইতেছিল। বোটের দীর্ঘ মাস্তলে দুইখানি পাল তুলিয়া দেওয়া হইল। পালে বাতাস লাগিয়া তাহা ফুলিয়া উঠিল; বায়ুবেগে বোট প্রতিকূল স্রোত ভেদ করিয়া, প্রভাত-বাত- বিক্ষুব্ধ নদীতরঙ্গ বক্ষে দলিয়া স্টিমারের মতো বেগে অগ্রসর হইতে লাগিল; বোটের বক্ষস্থলে ও উভয় পার্শ্বে আহত তরঙ্গরাশির তর-তর কল-কল ছল ছল ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ হইতে লাগিল। আমরা হর্ষোচ্ছ্বসিত হৃদয়ে নদীর উভয় কূলের দিকে চাহিয়া তীরের শোভা দেখিতে লাগিলাম, মধুর শারদ প্রভাতে মেঘ ও রৌদ্রের ছায়ালোকে প্রতিফলিত পল্লীপ্রকৃতির সেই বর্ষাসজল শোভার তুলনা নাই।
নদীর অপর পারে উচ্চ পাড়, পাড়ের নিচে হাঁড়োল। জলরাশি সেখানে ক্রমাগত ঘুরিতেছে। স্রোতের বেগ সেখানে বড়ো প্রবল ; ঘূর্ণিত জলে ঝাউ গাছের দীর্ঘ ছায়া পড়িয়াছে প্রভাত বাত্যাহত মৃদু-বিকম্পিত ঝাউ-শীর্ষ হইতে ক্রমাগত শর- শর ধ্বনি হইতেছে ; নদীর ছল ছল শব্দের সহিত ঝাউয়ের মর্মরধ্বনি মিশিয়া মধুর শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করিতেছে। এই সকল ঝাউ গাছের নিম্নে পূর্বে বাবুদের “কামরা ছিল, কামরার এখন চিহ্নমাত্র নাই, লতামণ্ডিত শৈবালাবৃত কৃষ্ণবর্ণ একটি জীর্ণ প্রাচীর 'বাবু'দের অতীত গৌরব ও পূর্ব ঐশ্বর্যের সমাধির চিহ্নস্বরূপ দণ্ডায়মান আছে। স্থানটি এখনও 'কামরার বাগান' নামে খ্যাত। বাগানের অবস্থাও শোচনীয় ; কয়েকটি আম ও লিচু গাছের অগ্রভাগ উন্নতশীর্ষ ঝাউ বৃক্ষশ্রেণীর অন্তরাল হইতে দেখা যাইতেছে। তাহার পাশেই খানিকটা উচ্চ পতিত জমি, কয়েকটি তাল ও খর্জুর বৃক্ষ ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে দণ্ডায়মান। তাল গাছে কাঁদি কাঁদি কালো তাল ফলিয়া আছে। একটা তাল গাছের মাথায় বসিয়া একটা চিল রোদ পাহাইতেছে কী শিকারের সন্ধান করিতেছে, তাহা বলিতে পারি না, মধ্যে মধ্যে বিদীর্ণ কণ্ঠে 'চি-ই-ই' শব্দে ডাকিয়া উঠিতেছে, তাহা ক্ষুধার্তের আর্তনাদ বলিয়াই মনে হইল। ধোপা ও ধোপানিরা পাটে কাপড় আছড়াইতেছে, অন্য পাড় হইতে তাহার প্রতিধ্বনি আসিতেছে। খর্জুর বৃক্ষের নিবিড় পত্ররাশির মধ্যে গোটাকত ছাতারে পাখি বসিয়া 'ক্যাচ ক্যাচ' শব্দে ডাকিতেছে এবং একটি পক্ষী বৃক্ষপত্র হইতে উড়িয়া মাটিতে বসিলেই অন্যগুলিও তাহার অনুসরণ করিতেছে। ধোপারা রাশি রাশি কাপড় কাচিয়া খোলা মাঠে মেলিয়া দিয়াছে ; প্রশস্ত মাঠ শুভ্রবশে আবৃত হইয়া শ্যামায়মান দূর্বাদলের বৈচিত্র্য ভঙ্গ করিতেছে।


পাথারে

দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত 
সেকালের চিত্র চরিত্র

সংকলন, সম্পাদনা, টীকা ও ভূমিকা : শতঞ্জীব রাহা

মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।