ঘোষাণী। সেকালের চিত্র চরিত্র

অনেককাল পর্যন্ত বামা আমাদের বাড়ি দুধের যোগান দিয়াছিল, যখন সে প্রথম আমাদের দুধ দিতে আরম্ভ করে, তখন আমরা বাংলা ইস্কুলের ছোকরা। তাহার বয়স বোধ করি তখন ত্রিশ পার হইয়া থাকিবে, তাহার সুদীর্ঘ চারি হস্ত পরিমিত দেহ, তাহার ওপর এক অপরিচ্ছন্ন শাড়ি — আজীবনে তাহা আর রজকের করস্পর্শে পবিত্রতা লাভ করিতে পারে নাই, মস্তকে অপরিসর অঞ্চলের সম্মুখে ও নিম্নে রুক্ষ চুলের গোছা, নাসিকায় লাল ও সবুজ পাথর বিশিষ্ট ঝুমকো পরানো দুল্যমান নথবতুল, এবং কক্ষে বংশচোদা সমলঙ্কৃত দুগ্ধপূর্ণ প্রকাণ্ড এক কলস দেখিয়া মনে। হইত রক্ষাকালী স্বয়ং ঘোষাণী মূর্তিতে পল্লীশিশুগণের জীবন রক্ষার্থ গৃহে গৃহে সুধাবিতরণ করিয়া ফিরিতেছেন— সেই সুধায় এত পর্যাপ্ত পরিমাণে জল সংমিশ্রিত।

থাকিত যে তাহা গলাধঃকরণ করিতে কোনো শিশুরই প্রবৃত্তি হইত না, শিশুর পিতামাতাগণ ঘোষাণীর দুগ্ধ বিশ্বেশ্বরকে দান করিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন। বামা ঘোষাণী গোবিন্দপুরে সর্বজনপরিচিতা ছিল। গোবিন্দপুরের সীমানার মধ্যে কে তাহাকে না চিনিত! কোন পাড়ার অন্তত দুই এক পরিবারেও সে দুধের যোগান না দিত! সে তাহার গৃহস্থালির ষোলোআনা মালিক ছিল, আর তাহার স্বামী কালাচাঁদ স্বগৃহে নিতান্ত নির্লিপ্ত প্রবাসীর মতো বাস করিত, ঘোষাণীর ভয়ে বেচারার মনে শান্তি ছিল না, কিন্তু তথাপি তাহার সেই ভয়ের মধ্যেও একটা অখণ্ড নির্ভরতা ছিল।

গো-দোহনই কালাচাঁদের সর্বপ্রধান কাজ ছিল, কিন্তু পঞ্চান্ন বৎসর বয়স হইবার পূর্বেই গৃহিণী তাহাকে ইহা হইতেও বঞ্চিত করিল, সুতরাং তাম্রকূট ধূম্ররূপ পেনশন পান করিয়াই তাহার ঘোষাণীর বাক্যযন্ত্রণাদগ্ধ অবসর অতিবাহিত হইতে লাগিল । গোদোহন কার্য হইতে তাহাকে অবসর দানের একটু ইতিহাস আছে, তাহা উল্লেখযোগ্য।

কোনো ব্যক্তি নির্জলা দুগ্ধলাভের দুরাশার বশবর্তী হইয়া তাহার বাড়িতে আসিলে কালাচাদ তাহার চক্ষে ধুলা দিয়া দুধে জল মিশাইয়া দিবে, এতটুকু সামান্য চতুরতাও তাহার ছিল না, তাহার এতখানি বুদ্ধিহীনতা ঘোষাণী কী করিয়া মার্জনা করে? একদিন এক ব্রাহ্মণ দুধ কিনিতে আসিয়া কালাচাদকে বলিল— 'ঘোষের পো, খুব খাঁটি দুধ চাই, ঔষধ খেতে লাগবে, আমার সামনে গাই দুয়ে দাও। ঘোষের পো বলিল—'তার আর ভাবনা কী ঠাকুর, ছ-টা পয়সা ফেলো, এক সের নিষ্ঠে দুধ নিয়ে যাও, দুধ তো নয় যেন বটের আটা, আমার কুলে গাইটার ‘বকনা' পড়েছে (প্রসবের পর অনেক দিন গিয়াছে) কিনা!' ঔষধির উপাদান করিবার জন্য দুগ্ধ- ঠাকুর অগত্যা নগদ ছয় পয়সা দিতেই স্বীকার করিল, ভাবিল, কাজ হস্তগত হইলে চারিটা, বড়ো জোর পাঁচটা পয়সা ফেলিয়া দিলেই চলিবে। আশ্বাস পাইয়া কালাচাদ কেঁড়ে লইয়া গোদোহন করিতে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কেঁড়ের মধ্যে আধসের জল লইতে ভুলিল না। কেঁড়েটি গোয়াল ঘরের সম্মুখে রাখিয়া সে খোঁয়াড় হইতে বাছুর খুলিয়া দিল। নয় মাসের বাছুর, আগের দিনের অপরাহ্ন হইতে সে বাঁধা আছে, গলার দড়ি খুলিবামাত্র সে তীরবেগে মায়ের বাঁটে গিয়া ঢুঁ মারিল। তাহার পথের উপরই কালাচাঁদ কেঁড়েটা রাখিয়াছিল, গোবৎসরের পদাঘাতে কেঁড়ে দ্বিখণ্ড হইয়া গেল, এবং বেবাক জল মাটিতে গড়াইয়া পড়িল। ঠাকুর নিকটেই দাঁড়াইয়া ছিল, সে কেঁড়ের ভিতর জল দেখিয়া একেবারে আগুন হইয়া উঠিল, বলিল – 'কেঁড়ে ভাঙবে না? বামনকে ফাঁকি দিতে চাস, আমি কি যে সে ব্রাহ্মণ। পৈতে ছুঁয়ে শাপ দিলে তোর মতো তিন লক্ষ ছাপান্ন হাজার নন্দবংশ ভস্ম হয়ে যায়; আমি সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি, তবু জোচ্চোরি খাটাতে চাস, পাজি বেটা!'

কালাচাদ কেঁড়েটি হারাইয়া বড়ো দুঃখিত হইল, মোটে সাড়ে তিন বৎসর হইল টেংরামাটির হাট হইতে দেড় পয়সা দিয়া কেঁড়েটি কিনিয়া আনিয়াছে, সেই কাল হইতে ইহাতে গরু দুহিতেছে, সুতরাং প্রায় নূতনই ছিল। ঘোষ কিঞ্চিৎ কাতর হইয়া বলিল—'যাও ঠাকুর তোমার দ্যাড় আনার দুধের জন্যি মোর দ্যাড় পয়সার কেঁড়ে গেল, তা ঠাকুর অত গোঁসা করো ক্যান, দুদে জল মিশোনোটা যে মোদের অভ্যেস, তোমরা ফলার করতে গিয়ে নুচি-সন্দেশ গামছায় বেঁধে বাড়ি আনো ক্যান?' ঠাকুর কণ্ঠস্বর আরো উচ্চ করিয়া বলিল—'সন্দেশ বাড়ি আনা আর দুধে জল মিশোনো সমান কাজ। তবে ঠাকুরবাড়িতে পুজোয় আমি চণ্ডীপাঠ করি আর তুই দুধ যুগিয়ে মরিস কেন ? বেটা ভোমা গোয়ালা, সাধে কি তোদের অন্ন হয় না।' শূন্য পাত্র হস্তে ঠাকুর প্রস্থান করিল। ঘোষাণীর হস্তে কালাচাঁদের লাঞ্ছনার আর সীমা রহিল না; আজ তাহার অতি কুপ্রভাত, কেঁড়ে ভাঙিয়া গেল, বাছুরটা মাতৃস্তন হইতে সেই অবসরে অধিকাংশ দুধ বেদখল করিয়া ফেলিল, বৌনির সময় নগদ 'খদ্দের' ফিরিয়া গেল, তদুপরি ঘোষাণীর সপ্রেম সম্ভাষণ। সেই পতিব্রতা রমণী গৃহপ্রাঙ্গণ গোময়ানুলিপ্ত করিতে করিতে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ঝঙ্কার তুলিয়া বলিল- “এতদিন যদি আমি মিনসেকে নাকে দড়ি দিয়ে চরিয়ে নিয়ে না বেড়াতাম তো ওর হাড়ে দুব্বো গজাতো।' বেচারির হাড়ে দুর্বা গজাইত কিনা বলা কঠিন, তবে ঘোষাণীর তীব্র তিরস্কারে তাহার মনে অতিরিক্ত পরিমাণে বৈরাগ্য গজাইয়া উঠিল এবং সমস্ত দিন অনন্যকর্মা হইয়া সে গরুর গোকালী (লেজের লোম) দ্বারা ছাঁদন দড়ি' পাকাইতে লাগিল। বেলা তৃতীয় প্রহরে ঘোষাণী তাহাকে ভাত খাইতে ডাকিতে গিয়া আবার ঝঙ্কার দিয়া বলিল – বলি দড়ি কী হবে? ঘোষ মুখ ভারি করিয়া বলিল—'গলায় দিয়ে মরবো।

দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত 
সেকালের চিত্র চরিত্র

সংকলন, সম্পাদনা, টীকা ও ভূমিকা : শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী 

মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা 
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।