মেস-হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

"আমাদের হোস্টেলবাসের সময়ই পার্ক সার্কাসের মোড়ে আরসালান রেস্তোরা খোলা হয়। একদিন ঠিক হলো সবাই মিলে গিয়ে খেয়ে আসা হবে। মুশকিল হচ্ছে আমরা প্রায় সব্বাই ট্যাঁকখালির জমিদার ছিলাম। হোস্টেল আর ক্লাস চার্জ বাদ দিয়ে কলকাতায় ফুটানি করার মতো টাকা পয়সা হাতে থাকত না। তা কখনও সখনও জনাব এরদোগাদেরও তো নিজেকে গণতান্ত্রিক বলতে সাধ জাগে, সেই সুবাদেই একবার আরসালান যাওয়া হলো। গিয়ে দেখলাম ওখানকার ওয়েটারগুলো আমাদের থেকে পরিষ্কার জামা পরে ঘুরছে। বারো ক্লাসে ইংরেজিতে দুপেপার মিলে একচান্সেই পাশ করার অপরাধে সব্বাই ইংরেজিতে লেখা মেনুকার্ডটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। ভাবখানা এমন, 'হে তালেবের, অর্ডার দিয়া আমাদিগকে উদ্ধার করুন।'

কিন্তু আমার দৌড় তো বহরমপুর বাস স্ট্যাণ্ডের আদি ঢাকা হিন্দু হোটেল আর নিতাইয়ের চপের দোকান অব্দি। কাতলা মাছের কালিয়া কি এঁচোড়ের চপ অব্দি বুঝতে পারি। পেয়াঁজির গুণমান নিয়ে বক্তিমে ঝাড়তে পারি। আরেকটু তোল্লাই পেলে হয়ত বিষ্ণু দে-ও দু-একলাইন অথবা বঙ্গ রাজনীতিতে দুর্বোধ্য কোনো দলের পলিটিক্যাল স্ট্যাণ্ড বোঝার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু জেলুসিল খাওয়া পেটে হরেক মোগলাই খানার মর্ম বুঝবো ক্যামনে?

শেষ অব্দি, রুমালি রুটির সাথে মুরগির কিছু একটা অর্ডার দেবার কথা ঠিক করা হলো। মেনুকার্ড দেখে একটা বেশ কাব্যিক নাম পাওয়া গেল, 'হার্ট অফ দ্য চিকেন' গোছের। আমি ক্লাস সিক্সে 'দেবদাস' পড়ে কেঁদে বালিশ ভেজানো পাবলিক, ভাবলুম না জানি কি মহার্ঘ খাবার। খাস কলকাতার খানদানী মোগলাই রোস্তোরার শাহী মুর্গার হার্ট। সেকি আর য্যায়সা ত্যায়সা আইটেম হবে?

তাপ্পর খাবার টেবিলে এলো। বুঝলাম আরসালানের মালিক মেনুকার্ডে কবিতা লেখেন না। হার্ট অফ দ্য চিকেন মানে আক্ষরিক অর্থেই পোলট্রির মুর্গির কলজের ঝোল। ইসলামে রেস্তোরায় গণপিটুনির বিধাম নেই। তাই সেদিন অক্ষত অবস্থায় হোস্টেলে ফেরা গিয়েছিল।

আর হ্যাঁ, সেদিনই প্রথম জেনেছিলাম রুমালি রুটি মানে রুমাল টুমাল নয়, সেরেফ পাতলা রুটি মাত্র। অবশ্যি, এরকম ঘটনা এটাই প্রথম নয়। সাড়ে চুয়াত্তরে 'মাসিমা মালপো খামু'র রোমান্টিসিজমে মজে গিয়ে মালপোয়ার খোঁজ করছিলুম। শুনলাম যে বহরমপুরে লালদিঘির ধারে জয় মা কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে মালপোয়া পাওয়া যায়। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে একদৌড়ে কিনে এনে বাড়িতে দেখি এতো আমাদের চিরপরিচিত 'আধাঁসা'। মুসলিম বাড়িতে হামেশাই হয়। মালপোয়া রসে ভেজানো হয় আর আধাঁসা শুকনো থাকে এই যা তফাৎ। 

হোস্টেলের রাঁধুনির সাথে পালা করে আমাদের মাঝে মধ্যে বাজার করতে যেতে হতো। একদিন মাংস কিনতে গিয়ে শান্তশিষ্ট সোহেল রেগে কাঁই। মাংসের দোকানদার নাকি দন্ত বিকশিত করে সোহেলকে বলেছে—তুমলোগ তো এতিম হো, গোস্ত ক্যায়সে খাতে হো?? 

এরও অনেকপরে ফ্রিজে গোস্ত রাখার অপবাদ দিয়ে আমার দেশে মুহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মারা হবে। পাকিস্তানের মতোই আমরাও সংখ্যালঘুদ্বেষী ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হবার দিকে এগোবো। একটু একটু করে পালটে যাবে আমার দেশ। এতদিন পরেও অচেনা ঠেকবে এতকালের প্রতিবেশীরা। পোশাক দেখে জঙ্গী চিনতে চাইবেন সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী।

তখনও ধনী-গরিব ইত্যাদি বিভাজন মাথার ভিতরে প্রবল হয়ে ওঠেনি। স্বাদবদলের জন্য খেতে চাইলে যেতাম থানার ক্যান্টিনে। ১২ টাকায় মাছ ভাত পাওয়া যেত। মাছ একপিসই। কিন্তু ভাত তরকারি যত খুশী। মাঝে মধ্যেই খেতে যেতাম। সেখানে খেতে যেতেন স্থানীয় শ্রমিকরা। আমাদের শৌখিন খাওয়ার পাশে তাদের খিদের খাওয়াটা চোখে পড়তো। এর বছর আটেক পরে বীরভূম সীমান্তে ইসকুলে চাকরি করতে গিয়ে মিড ডে মিল না হলে কীভাবে বাচ্চাদের দুবেলা পেটের ভাত জোটে না, সেইটে দেখেছিলাম। কী একটা কারণে সেদিন মিড ডে মিল রান্না হয়নি। বাচ্চারা খিদের চোটে মুড়ি চিবোচ্ছে। কারণ তাদের বাড়িতে রাতের আগে ভাত হবে না। প্রিভিলেজড হওয়ার কিছু পাপ থাকে। অনেকদিন সেই দৃশ্যটা আমায় তাড়া করে বেড়িয়েছে।

হোস্টেলে ছুটির সময় বাড়ি ফিরতাম লালগালা লোকালে। স্টেশনে ভিক্ষে করতেন এক বৃদ্ধা মহিলা। ওপার বাংলা থেকে সব হারিয়ে এপারে এসে জুটেছেন। কাজ করে খাওয়ার মতো শরীর নেই তাই দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার জন্য ভিক্ষে করতে হয়। ট্রেনের জন্য বসে থাকার সময় আমার সাথে তার কথা হতো। ওপার বাংলায় বাধ্য হয়ে ফেলে আসা ঘরদোর উঠোনের গল্প করতেন। কীভাবে রাতারাতি তাদের অধিকাংশ চেনা প্রতিবেশীরা পালটে গিয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে প্রাণ হাতে করে সীমান্ত পেরোনো। সেই বৃদ্ধা মহিলা আমার নাম জানতেন না। ভয় হতো কোনো দিন আমার নাম জানলে আমাকে ঘৃণা করবেন না তো! বিকেলের প্ল্যাটফর্মে যখন রোদ্দুর পড়তো, তখন তিনি বলতেন তার দেশে ফেরার স্বপ্নের কথা। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, একদিন নিশ্চয়ই দেশে ফেরার ট্রেনে তিনি চেপে বসবেন। আজ অনেক বছর তাঁর সাথে দেখা নেই। তিনি তার শেকড়ে ফেরার ট্রেন পেয়েছেন কিনা জানি না।

মুশকিল হচ্ছে বাড়ি ফিরতে চাইলেই কি সবার বাড়ি ফেরা হয়? সবার বাড়ি ফেরার ইচ্ছেগুলো কি আর ঠিকানা খুঁজে পায়?

বাড়ি থেকে যখন হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল, তখন প্রথম প্রথম বেশ দিব্যি লাগতো। পরে চাপা মনখারাপগুলো বেরিয়ে আসতে থাকল। আমার দোতলার পুরোনো ঘর, কড়ি বর্গার ছাদ, ঘরের পিছনে জানলার বাইরে তেঁতুল গাছ, সব্বাইকে মনে পড়তে থাকল। আর মনে পড়তো আমার মা-কে। সন্ধেবেলা চায়ের কাপ হাতে মায়ের সাথে বসে আড্ডা হতো। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। আঠারো বছর গলার কাছে পাকিয়ে উঠতো একরাশ মেঘ।

মাঝরাতে সব্বাই যখন ঘুমিয়ে যেত, তখন হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। ওই যে মাথার উপরে চাঁদ দেখা যাচ্ছে, সেটা তো আমার বাড়ি থেকেও দেখা যায়। তাহলে আর ঠিক কটা বাড়ি পেরোলে আমার বাড়ি পৌঁছানো যাবে?

পৌছোতে নিশ্চয়ই ভোর হয়ে যাবে। দরজা খুলে মা কেমন অবাক হয়ে যাবেন। ছোটো ভাইটা ছুটে আসবে। আব্বা ঘুমভাঙা চোখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবেন— 'রাণা বাড়ি ফিরলি?' 

মাথার ওপরে এখনও চাঁদ ওঠে। সে চাঁদ আমার শহরের বাড়িতেও আলো দ্যায়। সে বাড়িতে এখন আমার মা থাকেন। তার শ্রান্ত মুখেও চাঁদ তার নরম আলো বুলিয়ে দেয়? ক্লান্ত চোখে তিনি আজও অপেক্ষায় থাকেন ছেলে কবে বাড়ি ফিরবে।

আর আমি তার কুড়ি বছর পরে পূর্ব কলকাতার বহুতলে বসে। আমি এখনও বাড়ি ফেরার ঠিকানা খুঁজি। ঠিক কটা দিন পেরোলে আবার বাড়ি ফিরতে পারবো তার হিসেব কষি। আমার খামে বাড়ি ফেরার ঠিকানা লেখা থাকে না। তাই স্বপ্নে হাতড়ে বেড়াই পুরানো ঘর-উঠোন-বারান্দা। 

আমার আব্বা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই স্বপ্নে।

আমি তো একদিন নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরব আব্বা।।

তুমি কি আর সত্যিই ফিরবে না?

আমার যে তোমায় কুড়ি বছরের অনেক অনেক কথা, জমানো অভিমান না-বলা রয়ে গেল।"



জাননগরের কিসসা
রাণা আলম 

মেস-হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায় 

প্রচ্ছদ : মেখলা ভট্টাচার্য 
মুদ্রিত মূল্য : ৬২০ টাকা 

#সুপ্রকাশ 


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।