শ্যাম বাউল। সেকালের চিত্র চরিত্র

তখন প্রত্যেক গৃহেই এক একটা চরকা থাকিত, ব্রাহ্মণীগণ অবসর পাইলেই পৈতা কাটিতেন, সূক্ষ্ম পৈতার তখন অত্যন্ত আদর ছিল এবং অনেক উপায়হীনা বিধবা ব্রাহ্মণী শুদ্ধ পৈতা বেচিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেন। সূতা কাটার এই রকম প্রাদুর্ভাব ছিল বলিয়া কোনো কোনো গ্রামে শ্যাম বাউলের কীর্তন হইবার কথা উঠিলে পল্লীবাসীগণ বলিত—
বাজলো শ্যাম বাউলের খোল
যত মাগী চরকা তোল। 

রমণী সমাজে শ্যাম বাউলের কীর্তনের এতই প্রতিপত্তি ছিল।
কৃষ্ণনগরের রাজবংশ চিরকাল শক্তিমন্ত্রোপাসক। ভবানন্দ মজুমদার এই বংশের আদি পুরুষ, মজুমদার মহাশয় স্বয়ং অন্নপূর্ণার উপাসক ছিলেন, অন্নপূর্ণা শক্তিরই রূপান্তর, কৃষ্ণনগরের রাজপরিবার বিভিন্ন স্থানে কালীমূর্তি এবং শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠাপূর্বক মন্দির নির্মাণ করিয়া দিয়াছেন এ দৃষ্টান্ত বিরল নহে; তন্মধ্যে কৃষ্ণনগরে সুবৃহৎ আনন্দময়ী কালীর মন্দির ও কৃষ্ণগঞ্জের সন্নিকটে শিবনিবাস নামক স্থানের মন্দিরত্রয়ের কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে।

কিন্তু পক্ষান্তরে এই বংশে বিষ্ণুভক্তিরও নিদর্শন বিরল নহে, কৃষ্ণনগরের সুবিখ্যাত বারোদালে ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই বারোদোল উপলক্ষে লক্ষ্মী নারায়ণের দ্বাদশটি বিভিন্ন নামীয় মূর্তি কৃষ্ণনগর রাজভবনে একত্রিত করা হয়, তন্মধ্যে অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ, বিরুইর মদনগোপাল এবং ত্রিহট্টের কৃষ্ণরায়ের নাম সমধিক উল্লেখযোগ্য। এই সকল বিগ্রহের সেবাকার্য নির্বাহের জন্য তাহাদের পীঠস্থানে কৃষ্ণনগর রাজদত্ত যে সকল দেবত্র জমি আছে তাহার পরিমাণ নিতান্ত অল্প নহে। বলাবাহুল্য এই সকল বিগ্রহের উৎপত্তি ও স্থিতি সম্বন্ধে এক একটি রোমাঞ্চকর জনশ্রুতি আছে এবং অনেক ভক্ত তাহা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিয়া থাকে।
অতএব দেখা গেল শক্তি উপাসক এই রাজবংশে বিষ্ণুভক্তির বীজ উপ্ত হইয়াছে। শক্তি মন্ত্রোপাসকগণ প্রায়ই বিষ্ণুবিদ্বেষী হইয়া থাকে, কৃষ্ণনগর রাজবংশে যখন বিষ্ণুভক্তি প্রবেশ করিয়াছে তখন একথা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে কোনো বিশেষ কারণেই এরূপ হইয়াছে। কোন্ রাজার সময়ে যে এই পরিবর্তন সংঘটিত হইয়াছে তাহা কৃষ্ণনগরের প্রাচীন অধিবাসীগণের জানা থাকিতে পারে; আমরা কোন অশীতিপর বৃদ্ধের মুখে গল্প শুনিয়াছে যে রাজা গিরীশচন্দ্রের সময় হইতে এই রাজবাড়িতে কীর্তন গানের প্রথা প্রবর্তিত হয়, তৎপূর্বে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে কীর্তন হইবার নিয়ম ছিল না, নদীয়া জেলায় কীর্তন গানের বিশেষ প্রাদুর্ভাব করিতে পারে নাই। শ্যাম বাউলই রাজা গিরীশচন্দ্রের সম্মুখে তাঁহার আপনার অসাধারণ সংগীতদক্ষতার পরিচয় প্রদানপূর্বক যে নিয়ম প্রবর্তিত করিয়া গিয়াছেন তাহা আজও পুরুষানুক্রমে অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে।

কৃষ্ণনগরের রাজবংশ শাক্তই হোন বা বৈষ্ণবই হোন তাহাতে সাধারণের কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই এবং এই রাজবাটিতে, কীর্তন না হওয়ার প্রথা বর্তমান থাকিলেও তাহাতে তেমন বিস্ময়ের কোনো কারণ ছিল না, কিন্তু শ্যাম বাউলের ন্যায় একজন সামান্য বৈরাগী—পণ্ডিতও নহে বিজ্ঞও নহে, কিরূপে যে অসাধারণ বুদ্ধিমান, দৃঢ়-চিত্ত রাজা গিরীশচন্দ্রকে তাঁহার বংশ-প্রচলিত চিরন্তন বাধা অতিক্রমপূর্বক তাঁহার গৃহে কীর্তন গাহিবার অনুমতি প্রদানে প্রবৃত্ত করিয়াছিল তাহার গল্প সাধারণের নিকট কৌতূহলজনক হইবে তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই।

রাজা গিরীশচন্দ্র প্রায় প্রত্যহই কর্মচারিবর্গের সহিত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দরবারে বসিতেন, সর্বসাধারণ সেখানে উপস্থিত হইয়া আপনাদিগের প্রার্থনা তাঁহার গোচর করিতে পারিত। শ্রেষ্ঠ কীর্তনীয়া বলিয়া শ্যাম বাউলের খ্যাতি ছিল, সে কৃষ্ণনগরের বাটীতে একবার কীর্তন গাহিবার অভিলাষে রাজ-সন্নিধানে সাক্ষাৎ করিতে গেল। প্রত্যহ প্রাতঃকালে সে রাজ দরবারে গিয়া গললগ্নীকৃত বাসে দণ্ডায়মান থাকে, তাহার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তির দিকে কাহারও লক্ষ্য করিবার অবসর হয় না, কর্মচারীবর্গ প্রতিদিন তাহাকে রাজবাড়িতে উপস্থিত দেখিয়াও তাহাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেন না, সে কাহারও নিকট তাহার প্রার্থনা জ্ঞাপন করে না; এইরূপে কিছুদিন। যায়, একদিন রাজা তাঁহার প্রধান অমাত্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন— 'এ-লোকটি কে,

কেনই বা সে প্রত্যহ একভাবে দরবারে আসিয়া দাঁড়াইয়া থাকে।' রাজার কথা শুনিয়া দেওয়ানজি কৌতূহল পরতন্ত্র হইয়া শ্যামকে জিজ্ঞাসা করিলেন— 'বাপু তুমি কে? কেনই বা প্রতিদিন এখানে আসিয়া দাঁড়াইয়া থাক, তোমার কোনো নালিশ থাকিলে তাহা মহারাজের নিকট প্রকাশ করিতে পারো, তিনি জানিতে ইচ্ছুক আছেন।

শ্যাম সাষ্টাঙ্গে প্রণামপূর্বক রাজাকে আপন পরিচয় জ্ঞাপন করিয়া বলিল – 'ঠাকুর (কৃষ্ণনগর-রাজ এই নামেই সাধারণ কর্তৃক সম্বোধিত হইয়া থাকেন), রাজবাড়িতে আমি একপালা কীর্তন গাহিব, আমার অনেক দিনের আশা, আমার এই বাঞ্ছা পূর্ণ করিতে হইবে।'

রাজা বলিলেন—'এ রাজবাড়িতে যাহা কখনও হয় নাই তুমি তাহারই জন্য প্রার্থনা করিতেছ?'

শ্যাম সবিনয়ে উত্তর করিল — 'অন্যায় প্রার্থনা হইলে রাজদ্বারে কখনও তাহা উত্থাপন করিতাম না। দেবতার গুণানুকীর্তন করিতে যে কোনো বাধা আছে আমার ক্ষুদ্র মতিতে তাহা বোধ হয় না।'


শ্যাম বাউল

দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত
সেকালের চিত্র চরিত্র 

সংকলন, সম্পাদনা, টীকা ও ভূমিকা : শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা 
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।