ঢাকার মেস হোস্টেল । মেস হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন

দেখতে গেলে নগরায়নের প্রক্রিয়াগত দিক থেকে ঢাকা শহরের জন্য আলাদা করে বলার কিছু নেই। সমাজবিজ্ঞানগত নিয়মেই ঢাকা শহরের আড়ে বহরে বিস্তার ও জন-সমাগমের আকীর্ণতা। ক্রমেই ঢাকা 'বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি'র শহর হয়ে ওঠে। প্রথমে এসেছিলেন অর্থ-সন্ধানী স্বার্থবাহরা, প্রশাসনিক দপ্তরগুলিতে পেশাসন্ধানীরা, উচ্চ ও আধুনিক শিক্ষাগ্রহণেচ্ছুরা — তারপর আরও কত শ্রেণীর মানুষ। গড়ে উঠছিল এদের জন্য আবাস — বাসাবাড়ি মেসবাড়ি- হোস্টেল-ব্যারাক-বোর্ডিং হল ইত্যাদি। প্রথমদিকে ঢাকা শহরে পেশাসফল পিতা বা আত্মীয়দের সঙ্গে বাসাবাড়িতে ছাত্রদের বাস, কখনও কোনো স্বচ্ছল আত্মীয় বা পরিচিতের আশ্রয়ে। তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপনা, প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানেই ছাত্রদের জন্য বাসগৃহ স্থাপনার উদ্যোগ, পাশাপাশি চাকরিজীবীদের নিজস্ব-ব্যবস্থায় আশ্রয়-সন্ধান — ক্রমেই বহিরাগত বিপুল- সংখ্যক মানুষের জন্য পেশাদারিত্বের শর্তে আবাসস্থলের সংগঠিত বন্দোবস্ত — মোটামুটি এই ছিল সব নগরের মতোই ঢাকার নগরায়নকালে যৌথাবাস স্থাপনের প্রক্রিয়া।

ঢাকায় প্রথম এই ধরনের যৌথাবাস করে গড়ে উঠেছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও এবং বহিরাগত ছাত্রসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেলেও (১৮৪৩ সালেই বহিরাগত ছাত্রদের বিষয়ে প্রথম তথ্য পাওয়া যায়) ১৮৮০ সালের আগে এই কলেজের কোনো ছাত্রাবাস গড়ে ওঠেনি। সেই ছাত্ররা নিশ্চিভাবেই হয় আত্মীয় পরিচিত বা বড়োমানুষদের বাড়িতে আশ্রয় পেতেন অথবা নিজেরা বাসা ভাড়া করে অতীব কষ্টের মধ্যে নিজেদের পাঠ চালিয়ে যেতে বাধ্য হতেন। সম্ভবত এরও আগে একটি হোস্টেল স্থাপনার সংবাদ পাওয়া গেলেও সেটি স্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- কর্তৃপক্ষের কোনো যথাবিহিত বা অনুমোদিত ভূমিকা ছিল না বলেই মনে হয়। এবং নামে হোস্টেল হলেও চরিত্রের দিক দিয়ে সেটি হয়তো মেসের থেকে বেশি কিছু ছিল না। নাম দেওয়া হয়েছিল 'ঢাকা হিন্দু ছাত্র হোস্টেল।' পুরোনো ঢাকার লয়্যাল স্ট্রীট বা পাটুয়াটুলিতে ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের (১৮৬৯ সালে মন্দিরটির উদ্বোধন হয়) ‘ভেতরে ছাত্রদের জন্য মেসটি প্রতিষ্ঠা করেন' আনন্দবন্ধু মল্লিক ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারী অভয়চন্দ্র দাস। সম্ভবত মন্দিরটি নির্মাণের সময়ই মন্দিরের পেছনের অংশে ব্রাহ্ম প্রচারকদের জন্য যে কয়েকটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল সেখানেই মুখ্যত ব্রাহ্ম ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাসটি স্থাপিত হয়। এই মেসে থেকে পড়াশুনো করতেন 'ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুল, (পরে) জগন্নাথ স্কুল, কে এল জুবিলি স্কুল, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল পোগজ স্কুল ও ঢাকা কলেজের ছাত্ররা।' সরকারি অনুদান পাবার জন্য হোস্টেল হিসেবে নামকরণ করলেও এটি আসলে মেসই ছিল। ছাত্রদের কাছ থেকে মেস কি হিসেবে পাঁচ টাকা থেকে আট টাকা পর্যন্ত নেওয়া হতো। এর মধ্যে সরকার ছাত্রপ্রতি মাসিক আট আনা ভর্তুকি থাকত। কে কোন ধরনের রুম ব্যবহার করবে এর ওপর নির্ভর করে বোর্ডারদের শ্রেণীকরণ করা হতো। চার ধরনের রুম বরাদ্দ করার ফি নির্ধারণ ছিল পাঁচ, ছয়, সাত ও আট টাকা। এই টাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল থাকা, খাওয়া, মেস ব্যবস্থাপক, ও কাজের লোকেদের বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক খরচাদি। প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরই হোস্টেলটিতে ৩৬ জন সদস্য ভর্তি হয়।... (২০ ফোরস্ : ২০১৪ ) 
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর স্মৃতিচারণায় জানিয়েছিলেন যে, তিনি রাজচন্দ্র হিন্দু হোস্টেলের বোর্ডার ছিলেন। সেটা ১৯০২ সাল। তিনি লেখেন :
...মেজদাদা ও আমি ঢাকা শহরে পড়তে যাই। সেখানে আমার মায়ের মামার বাড়িতে ছিলাম। আমরা দু'ভাই ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হই। তিন মাস এই আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার পর আমরা স্কুলের হস্টেলে চলে গেলাম। হস্টেলে থাকা-খাওয়ার জন্য প্রতি মাসে খরচ ছিল সাড়ে সাত টাকা....... ঢাকার এই রাজচন্দ্র হিন্দু হস্টেলে আমরা একরকম ভালোই ছিলাম। (মজুমদার ১৯৫৯)

একটা ছোটো ঘিঞ্জি এলাকায় গলির মধ্যে একটি বাড়িতে এক সারি ঘর। প্রথম শ্রেণী একতলার দু-পাশে, দু-সারির ঘর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণী এবং দু-সারির মাঝখানে এক সারি ঘর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী। ঘরের মধ্যে দিয়েই অন্য ঘরে যেতে হতো। চারদিক বন্ধ। সুতরাং আলো-বাতাস ঢোকার রাস্তা ছিল না। সব শ্রেণীর খাওয়ার মেনু ছিল একই। প্রত্যেক ছাত্রের নিজস্ব আলাদা থালা ছিল, থালার পেছনে ছেলেদের নাম খোদাই করা থাকত। রাত আটটার মধ্যে হোস্টেলে প্রবেশ করতে হতো। তারপর বন্ধ হতো হোস্টেলের গেট। (ইসলাম, ২০২১ )

তবু এই ঢাকা হিন্দু ছাত্র হোস্টেল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৮৮০ সালে 'সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে বাংলাবাজারের শ্রীচন্দ্র দাস লেনে (শ্রীশ দাস লেন?) রাজচন্দ্র হিন্দু ছাত্র হোস্টেল স্থাপিত হয়। এই হোস্টেল স্থাপনকে ঢাকা শহরে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। উল্লিখিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ঢাকায় বহিরাগত ছাত্রদের আবাসনের প্রচণ্ড সংকট দেখে এই সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসেন ফরাশগঞ্জের জমিদার, ঢাকার ধনাঢ্য ব্যাংকার' প্রতাপচন্দ্র দাস। তাঁর পিতা রাজচন্দ্র দাসের নামে নামকরণের শর্তে তিনি ঢাকা কলেজের অধীনে এই হোস্টেল নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত অর্থই প্রদান করেন এবং বছরে ৬০০ টাকা অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পর ১৮৮০ সালেই বাংলাবাজারের শ্রীশ দাস লেনে হোস্টেলটি চালু হয়। ১৮৯০ সাল নাগাদ চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হলে প্রতাপচন্দ্ৰ অনুদান ৬০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শিরীষচন্দ্র পিতার ধারা বজায় রাখেন।

১৮৮৩ সালেই এই হোস্টেলের ছাত্র সংখ্যা এসে দাঁড়ায় নব্বই জনে। ছাত্রদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে ১৯০৪ সালে নতুন হোস্টেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। পরে দুটি নতুন হোস্টেল নির্মিত হয়। নাম হয় সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেল [১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে হিন্দু হোস্টেলটির নাম হয় ঢাকা হল (এখন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল), সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেলের নাম হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ]।

ঢাকার মেস হোস্টেল 
সমরজিৎ দাস

মেস হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য : ৬২০ টাকা 

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।