শৈব্যা কথন। জয়া মিত্র।

"একটি জম্বুবৃক্ষের নিচে রোহিতাশ্ব পড়ে ছিল। বিস্তৃত প্রস্তরপট। হয়তো অপরাহ্নে লোকজন এখানে এসে বসে। তার একপাশে বৃক্ষের শাখার তলে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল আমার অসহায় বালকপুত্র । তার হাতে বৃক্ষের ক্ষুদ্র ভগ্নশাখা, আর মুখের কাছে, বৃষ্টি জলের মধ্যেও, এতটুকু রক্ত সেই অকরুণ শিলার উপর জমে আছে। স্বাচ্ছন্দ্যে আরামে সে জন্মেছিল, আরামে স্নেহে সুখে সে বেড়ে উঠেছিল। নিষ্ঠুর আত্মগর্বী রাজার অক্ষমণীয় অহংকারের কারণে সে আজ এইখানে পড়ে আছে। বুঝি যে মা তাকে দিনে তিনবার উদরপূর্তি করবার মতো আহাৰ্যটুকু দিতে পারে না, তাকে বিব্রত না করে সে নিজেই ক্ষুধানিবৃত্তির উপকরণ সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল। আমার কিছুতে প্রত্যয় হয় না যে সে আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারবে। সে কি জানে না যে তার দুঃখিনী মায়ের জীবনে সে-ই একমাত্র অবলম্বন ? যদি মাকে সে ত্যাগ করে যায় তবে চার বৎসরের এত কষ্ট শত লাঞ্ছনা অপমান সহ্য করিয়ে সেই মাকে কেন সে বাঁচিয়ে রেখেছে? একদিন তার ক্ষুদ্র বাহু দুটি দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সে বলেছিল— মাগো, যদি তুমি মরে যাও আমি তবে কার কাছে থাকব?

সেই কথা শুনে দুই মুষ্টি অধিক খাদ্যের আশায় আমি দুধের বালককে রৌদ্রে ঘুরে পুষ্পচয়নে যেতে দিই। বৎস, তুই ভাবলি না যদি তুই না থাকিস তোর হতভাগিনী মা কার কাছে থাকবে? তোকে ক্রোড়ে নিয়ে চরম অপমানের মধ্যে আমি সেই হৃদয়হীন, রাজার, স্বামীর, পিতার আশ্রয় থেকে বিতাড়িত, এই কঠিন বিশ্বে পা রেখেছিলাম। তোর ক্ষুদ্র দুর্বল দুই বাহু, তোর পরমনির্ভরতা মাথা মুখ আমাকে এই জীবনের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে, না হলে দাসীজীবনের লাঞ্ছনা সহ্য করার বহু আগে আমি কূপে ঝাঁপ দিতাম, উদবন্ধনে কি অগ্নিতে প্রাণ দিতাম।

রোহিতাশ্বকে আমি বোঝাচ্ছিলাম— বৎস, তুমি তো আমার প্রতি কখনও অকরুণ হওনি। কচি পেটে ক্ষুধার জ্বলন সহ্য করেও মাকে উদরপূর্তি হয়েছে বলে মিথ্যা বলেছ যেন মায়ের জন্য কিঞ্চিৎ অন্ন অবশিষ্ট থাকে। তবে আজ কেন সেই মায়ের ভালোমন্দের চিন্তা না করে তুমি রুধিরচিহ্ন নিয়ে এই ভূমিতলে নিরুত্তরে শুয়ে আছ? আমি চিরকাল জানি যদি কোনো প্রাণী এ সংসারে ভাগ্যহীনা শৈব্যার দুঃখ বোঝে তবে সে শৈব্যার পুত্র রোহিতাশ্ব। রাজপুত্র তুমি, সারা রাজপুরীর তুমি নয়নের মণি, মায়ের ভাগ্যদোষে আজ এইখানে শুয়ে আছ, চলো বৎস, মায়ের আঁচলে তোমার জল মুছিয়ে দেব, আজ রাত্রি তুমি মায়ের স্নেহের ক্রোড়ে যাপন করো, কাল প্রভাতে যেমন করে হোক তোমাকে নিয়ে আমি অযোধ্যা নগরে যাব, যদি মহারাজ বিমুখ হন, আমি নগরবৃদ্ধদের ডেকে বলব, এই রোহিতাশ্ব অযোধ্যার রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। এ রাজপুত্র, একে মহারাজ বিক্রয় করেননি। একে বারাণসীনিবাসী ব্রাহ্মণ ক্রয় করেনি। এ স্বাধীন। এ যেন নিজগৃহে নিজ পরিবেশে পালিত হতে পারে তা আপনারা দেখুন। ক্রোধিত হোয়ো না, ওঠো----

আমি জানি না কতক্ষণ আমি রোহিতাশ্বর সঙ্গে কথা বলছিলাম আর তাকে সিক্ত ভূমিতল থেকে আমার ক্রোড়ে তুলে নেবার চেষ্টা করছিলাম।

‘নারী, কার সঙ্গে তুমি বাক্যক্ষয় করছ? যা সত্য তাকে দেখো।

তোমার পুত্র মৃত। তার দেহে প্রাণের লেশমাত্র নেই—'

পদ্মমাধব স্বর কঠিন প্রস্তরখণ্ডের মতো আমার মস্তকে আঘাত করল । আমি রোহিতাশ্বের শরীরের উপর লুটিয়ে পড়লাম। বিপ্র কী দেখতে এসেছিল আমরা পলায়ন করি কিনা? সহসা আমার মনে পড়ল এই ব্যক্তি আমার পুত্রকে বৎসরের পর বৎসর অর্থাশনে রেখেছিল। দুই মুষ্টি খাবারের বিনিময়ে আমার শিশুকে সে বনে বনে প্রেরণ করেছে। এ-ই আমার পুত্রের হত্যাকারী। অন্ধক্রোধে আমার চক্ষুর সম্মুখে যেন রক্তবর্ণের ছায়া দুলে উঠল। কিন্তু ব্রাহ্মণ আমার ক্রোধ দেখে এতটুকুও বিচলিত হল না। বলল— নারী, শোকে তুমি আত্মবিস্মৃত হয়েছ। বিপদে পড়েও অকর্তব্য করতে নেই। রাজা ও ব্রাহ্মণের নিন্দা কোরো না, এতে পাতক হয়। তোমার ভর্তা দেশের রাজা, তিনি তোমার ইহকাল পরকালের প্রভু। তিনি স্বয়ং তোমাকে বিক্রয় করেছেন, আমি অর্থমূল্যে তোমাকে ক্রয় করেছি--- এতে অন্যায় কোথা ? বরং আমরা উভয়েই তোমাকে দয়া প্রদর্শন করেছি। মহারাজ পুত্রকে অর্থমূল্যে অন্যত্র বিক্রয় করতে পারতেন, তা না করে তিনি আত্মবিক্রয় করেছেন, পুত্রকে তোমার কাছেই থাকতে দিয়েছেন। আমিও তোমার অনুরোধে স্বয়ং ক্ষতিস্বীকার করেও তোমার পুত্রের দায়িত্ব নিয়েছি। রোগ ও মৃত্যু জীবশরীরের স্বভাব, এজন্য কারও ওপর ক্রোধ করা বৃথা। আর মৃত্যুর প্রতি ক্রোধ কোরো না, মৃত্যু স্বয়ং ধর্ম।

তার কথার উত্তর দিতে আমার ঘৃণা হচ্ছিল। রোহিত চলে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে। সেই করাল মুহূর্তের মধ্যে দাঁড়িয়েও সহসা আমি বোধ করলাম আমার সমস্ত ভয় জীর্ণবস্ত্রের মতো, শুষ্কলতার বন্ধনের মতো খসে পড়ে গেছে, আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নির্ভয়। আর তো আমার মায়াবন্ধন নেই যার কারণে আমি এইসব লোকের কাছে নতজানু হয়ে থেকেছি; আমি বললাম— বিপ্র, তোমাদের ধর্মের কথা আমাকে শুনিয়ো না। যে ধর্মে নিরপরাধ শিশুকে অনাথের মতো বিসর্জন দেওয়া যায়, যে ধর্মে গৃহে প্রচুর সংস্থান থাকলেও একটি শিশুকে বৎসরের পর বৎসর অর্ধভুক্ত রাখা হয়—

পদ্মমাধব আমার উগ্র ভাষা শুনে হয়তো অধৈর্য কিংবা ভীত হল। আমাকে বাক্য সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে বলল— আমি তোমার সাহায্যের নিমিত্তই এখানে রয়েছি। কিন্তু যদি তুমি ধর্মদ্বেষী কথা বলো আমি এ স্থান ত্যাগ করব। দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে, তুমি এখানকার পথঘাট চেনো না, শ্মশান এখান থেকে বহুদূর। আমি গৃহে গেলে তুমি পুত্রের দেহ নিয়ে এখানে বসে থাকবে যতক্ষণ না মাংসলোভী শিবাদল আসে—

হ্যাঁ, আমার আপন দেহের অংশে গঠিত সন্তানের সঙ্গে এই আমার শেষ সংলগ্নতা। আমার শরীরেরই অংশ যে শরীর তাকে পৃথিবীর সর্ব দুর্দশা থেকে মুক্তি দিয়ে জননী ধরিত্রীর ক্রোড়ে আবার ফিরিয়ে দিলে আমার কাজ শেষ হবে। আমার শরীরের ওই অংশ দাহ করা হয়ে গেলে অবশিষ্ট অংশকেও আমি নির্ভাবনায় অগ্নিতে বিসর্জন দিতে পারব।"


শৈব্যা কথন
জয়া মিত্র

প্রচ্ছদ: মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য: ১৬০ টাকা
#সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।