শেষ মৃত পাখি। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

পাহাড়ে বৃষ্টি নিষ্ঠুরতা এবং নির্জনতার উদযাপন ঘটায়। দার্জিলিং-এর বর্ষাকালকে যদি এক কথায় ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে তার নাম অবিশ্রাম, বিরতিহীন বৃষ্টি। কখনও আস্তে এবং কখনও মুষলধারে। যখন বৃষ্টির বেগ কম, পাহাড়ের নীচ থেকে মেঘের দল উঠে এসে কুয়াশায় ঢেকে নিচ্ছে চরাচর, আমার ঘরের জানালার কাচ ভেপে উঠছে। রাস্তাঘাটের স্যাঁৎসেঁতে ভেজা অন্ধকার ভেদ করে মাঝে মাঝে ছিটকে আসছে এক ঝলক ছাতার রং অথবা বাহারি পোশাকের আঘ্রাণ। কম সংখ্যায় টুরিস্ট। ম্যাল, চৌরাস্তা, কেভেন্টোর্সের ছাদ— সমস্তই ফাঁকা ফাঁকা। সন্ধে হলে একদম নিঝঝুম হয়ে যায়। ঘরের দেয়াল ঘেমে ওঠে। আড্ডা জমায় অদ্ভুত দেখতে পাহাড়ি পোকার দল। বনের ধারের পাইন, ইউক্যালিপ্‌টাস, বার্ডের ডাল থেকে সারাদিন টুপটাপ করে জল পড়বার আওয়াজ। ক্ষণিকের জন্য কুয়াশা কেটে গেলে আবছা জলরঙের মতো দেখা যায় নীচের দরিদ্র বস্তি। এই অবিরাম অবসাদের মতো বৃষ্টি মনকেও কীরকম বিকল করে দেয়। কাজ করতে ভালো লাগে না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় জানালার বাইরে এই ছাইরঙা আকাশ আর ফ্যাকাশে জন্ডিস রুমির মতো সূর্যের আলোকে চেটে দেখি। এমনিতেই অনিদ্রাতে ভুগি। দিনের বেলা ঘুম পায়, চোখের পাতা বুজে আসে। এমন প্রকৃতি আমাকে আরোই বেশি করে কাজে ফাঁকি দেওয়াবার ষড়যন্ত্র করেছে।

১৯০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ইংলিশম্যান কাগজে একটা লেখায় বলা হয়েছিল, 'দার্জিলিঙ হ্যাজ অলমোস্ট বিকাম দ্য প্লে-গ্রাউড অ্যান্ড নার্সারি অফ ক্যালকাটা'। স্বাভাবিক, সাম্রাজ্যবাদের চোখে দার্জিলিং-এর নিজের মূল্য কতটুকু, যদি না তা রাজধানীকে সার্ভ করে। কলকাতার নার্সারি হওয়াই এই শহরের ভবিতব্য ছিল হয়তো, যার তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল অসংখ্য নেটিভ কুলি, চা-বাগানের শ্রমিক, লেপচা নেপালি ভুটানি গোষ্ঠীদের আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা। এই বৃষ্টি, অবিরাম স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়া আর অবিচ্ছিন্ন কুয়াশা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এটাই সম্ভবত আসল দার্জিলিং, যার পেটের ভেতর লুকিয়ে থাকা রহস্যগুলোর সুলুকসন্ধান কোনোদিনই উপনিবেশের প্রভুদের নাগাল পাবে না।কাঞ্চনজঙ্ঘা, টাইগার হিলের সূর্যোদয়, অজস্র ফুলের সমারোহ, চিড়িয়াখানা, এসব পেরিয়ে গেলে যেটা পড়ে থাকে, চিতাবাঘের মতো ঘাপটি মেরে থাকা এই শহরের ইতিহাস এবং অস্তিত্বকে সম্ভবত অমিতাভ মিত্রর মতোই ভুলে গিয়েছে সবাই। অথবা, ভুলে গেছে কি? মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। অমিতাভ কি বিশ্বাস করতেন ?

শেষ মৃত পাখি
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
সঙ্গের ছবিটি প্রচ্ছদ নয়। নির্মাণ : অদ্বয় দত্ত, তিস্তান 

মুদ্রিত মূল্য: ৫২০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।