নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

"রাত্রির আঁধার ভেদ করিয়া জ্বলন্ত মশাল হতে কয়েকটি অশ্বারোহী ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া চলিয়াছে উপলবন্ধুর কান্তার-পথে। গতির প্রাবল্যে স্পষ্ট তাহাদের উদ্বিগ্ন ত্বরা। তাহারা যোদ্ধা নহে, দেখিয়া বণিক শ্রেণীর মনে হয়। অথচ তাহাদের সঙ্গে সামগ্রী বলিতে সামান্য একটি পোর্টলি ভিন্ন আর কিছুই নাই। অতএব ব্যবসায় নহে, অবশ্যই অন্য কোনও গূঢ়কর্মে এই নিতান্ত অসময়ে তাহারা চলিয়াছে যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশে। কালান দুর্গপরিসর সংলগ্ন প্রান্তরে যুদ্ধ শুরু হইয়াছে প্রায় ছয় মাস হইল। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের জীবনের শেষভাগে বিশাল সাম্রাজ্যের কিছু কিছু প্রান্তে বিজাতীয় শহরু পুনরায় শক্তিসংগ্রহ করিতে থাকে। উজ্জয়িনীর সীমান্তে নামগোত্রহীন এক শক-সত্রাপ উপদ্রব শুরু করিয়াছিল এক অতি তুচ্ছ বিবাদ লইয়া।

সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্তরাজবংশের স্পর্শমণি। যখন অস্ত্রধারণ করিয়াছেন, সে অস্ত্র ইরম্মদসম শত্ৰুহনন করিয়াছে। তাঁহার দীর্ঘজীবনের একটা বড় অংশই অতিবাহিত হইয়াছিল উপজাতীয় শক ও হূর্ণ সম্প্রদায়ের দমনে। সে কাজ তিনি সম্পন্ন করিয়াছেন বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে। উত্তর পশ্চিম হইতে আগত এই বিদেশী শত্রুদের প্রবল প্রহার করিয়া তিনি পরাস্ত
করিয়াছিলেন। তাঁহার জীবদ্দশায় শক ও হুগ আর তেমন ভাবে মাথা তুলিতে পারে নাই।

বর্তমান বিবাদের সূত্রপাতটি হইয়াছিল অবশ্য সমুদ্রগুপ্তের জীবৎকালেই। রণক্লান্ত সম্রাটের শরীর তখন বিশ্রাম চাহিতেছিল। তিনি অবসর লইয়া জোষ্ঠপুত্র রামগুপ্তকে করিয়াছিলেন দ্বিতীয় রাজধানী উজ্জয়িনীর শাসক। রামগুপ্তই পরিচালনা করিতেছিলেন যুদ্ধের গতিবিধি।

সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের জীবদ্দশায় সে যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয় নাই। জ্যেষ্ঠকুমারের বিচারবৈদগ্ধ ও যুদ্ধসাফল্যের সংবাদ পাটলিপুত্রে যাহা আসিয়া পৌঁছাইত তাহাতে উৎসাহব্যঞ্জক বিশেষ কিছুই থাকিত না। ক্রমশই মহারাজের স্বাস্থ্যের অবনতি হইতে থাকে। অবশেষে আসিল মহাগুরু নিপাতের ক্ষণ। রামগুপ্ত নেতৃত্বগ্রহণের তৃতীয় মাসে, রাজ্যের ভবিষ্যত সম্বন্ধে একরাশ নিরাশা লইয়াই সমুদ্রগুপ্ত প্রয়াত হইলেন।

লোকান্তরিত সম্রাটের রাজসিংহাসনে তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র রামগুপ্ত অভিষিক্ত হইলেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া তিনিও শত্রুদমনে সচেষ্ট হইয়াছিলেন। কিন্তু পিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতে তিনি সমর্থ হন নাই। প্রদীপের নীচেই থাকে অন্ধকার।

যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের অতীত হইবার উপক্রম হইলে রামগুপ্ত কনিষ্ঠ সহোদর কুমার চন্দ্রগুপ্তকে সমরাঙ্গনে ঠেলিয়া দেন। সময়ে থাকিতে ইহা হইলে বোধহয় অনেক পূর্বেই ইতিবাচক পরিণতি আসিত। কিন্তু যখন হইল তখন ইতিমধ্যেই হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের পরিস্থিতি আর নাই। আপাতত কুমার চন্দ্রগুপ্তই সম্রাটের প্রতিভূ রূপে কোনমতে দুর্গরক্ষা করিয়া আছেন। যুদ্ধের গতি স্তিমিত হইয়াছে, নির্ণায়ক ফললাভ হয় নাই।"

সীবন সংকেত
সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

অলংকরণ: ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়

আসছে নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।