অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

'এবার কী করবে?'

টুকু ঘাসের ওপর একটু আড়াআড়ি বসেছে। ওর নিখুঁত প্রোফাইল আমার নজরে আসছে।

'সমাজনীতি-রাষ্ট্রনীতি? নাকি মন দিয়ে পড়াশোনা?' আমার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করে যাচ্ছে টুকু।

আমি উত্তর দিচ্ছি না। তাকিয়েই আছি ওর দিকে। আজ কড়কড়ে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা কট্‌কি-প্রিন্টের সুতির শাড়ি প্লিট দিয়ে গুছিয়ে পরেছে টুকু। কালো ব্লাউজের কাঁধের কাছে সাদা পুঁতিওয়ালা একটা বড়ো সেফটিপিন দিয়ে আঁচলটা আটকানো। ঈষৎ পা-মুড়ে হাঁটু-দুটো থুতনির কাছে এনে বসেছে। ওর সাইড প্রোফাইলে আধখানা টিপ দেখা যাচ্ছে। কাঁধ ছুঁয়ে শাড়ির লম্বা আঁচল পেছনের ঘাসের ওপর অলসভাবে শুয়ে আছে। দুই-হাঁটু শাড়ির কুচিগুলোকে বহন করে ঠিক পায়ের পাতার ওপর এসে থেমেছে। ওর পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে না, পায়ের পাতাদুটি সায়ার চওড়া ক্রচেট-লেসে ঢাকা।

আমাদের সামনে কুন্তীর জল – আমাদের কৈশোরের, কৈশোরোত্তীর্ণ ছেলেকালের আশ্রয়।

আমি তাকিয়ে আছি কুন্তীর ওপারে।

আমি জানি—রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে টুকু কথা বলতেই পারে, সে কথা তির্যক হয়ে ওঠাও স্বাভাবিক।

দিন কয়েক আগেই নাইট স্কুলের কমিটির বার্ষিক মিটিং হয়ে গেছে।

মিটিংয়ের একবারে শেষপর্বের কাজ কমিটির নাম বা প্যানেল উপস্থাপনা। সেটা করতে গিয়ে কাজুর দাদা সলিল বেশ একটা বক্তৃতাই ফেঁদে বসল— 'কমিটিতে কারা থাকবে সেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবার পর মনে রাখতে হবে তা ব্যক্তিগতভাবে কারও যদি মনোমতো না-ও হয় তবু তা আমারই সিদ্ধান্ত। আমাদের নিজস্ব বক্তব্য থাকতেই পারে, সংগঠনের অভ্যন্তরে তা বলবার গণতান্ত্রিক অধিকারও আমাদের প্রত্যেক সদস্যের রয়েছে। কিন্তু যে-কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে, সাংগঠনিক দ্বিমতের ক্ষেত্রে উচ্চতর নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত আমাদের মেনে চলতে হয়—একেই বলে গণতান্ত্রিক অনুশাসন।' ইত্যাদি প্রভৃতি।

কমিটির নাম প্রস্তাবের পর বোঝা গেল এত লম্বা ও জ্ঞানগর্ভ ভাষণের আসল তাৎপর্য। যাদের কখনও নাইট ইস্কুল, হেল্থ-প্রোগ্রাম বা অন্যান্য কোনো কাজে দেখা যায় না, একটা সম্পূর্ণ বাক্য গুছিয়ে বলতে পারে না, তারাও আছে কমিটিতে। যাদের আমরা কেউ নাম শুনিনি তেমন কেউ কেউ, এমন কী ওদের চেলাগুলো পর্যন্ত কমিটিতে আছে। 

কমিটির নাম প্রস্তাব হতেই আমার পাশে বসা তরণীটা——'একী অ-শৈল্প কাণ্ ড' বলে লাফ দিয়ে উঠেছিল। আমি ওর পাজামা টেনে ধরেও বসাতে পারিনি। শেষে আমার ধমক খেয়ে নাক দিয়ে অসন্তুষ্টিসূচক ‘ফোঁৎ' করে একটা শব্দ করে ও বসে পড়েছিল।

আমাদের ডানদিকে কোণাকুণি কাজু-টুকুরা বসেছিল। আড়চোখে কাজুর দিকে চেয়ে দেখি ও জ্বলন্ত-চোখে শাড়ির আঁচল চিবোচ্ছে। কমিটিতে কৃষ্ণাদির নাম থাকলেও অন্য সদস্যদের নাম শুনে কৃষ্ণাদি এখন পাথরের মতো একপাশে বসে।

তনয় চোখের ইশারায় কাজু-টুকুকে শান্ত হতে বলে, চুপ করে থাকার ইঙ্গিত করে। সাম্প্রতিককালে সলিলের আচার-আচরণ, আমাদের সঙ্গে ব্যবহার মোটেও আমাদের পক্ষে সহনীয় নয়। কাজু আর তনয়ের ইস্যু নিয়েই ওর এই ভাবান্তর, সন্দেহ নেই। কিন্তু কাজু ছাড়ে না। মিটিং শেষ হওয়ার পর দাদাকে এ-নিয়ে ও প্রশ্ন করে বসে। সে দাদাসুলভ কৃত্রিম-গাম্ভীর্য নিয়ে বলে এটা নাকি উচ্চতর কমিটির সিদ্ধান্ত। একেই নাকি বলে গণতান্ত্রিক অনুশাসন !

শুধু তরণী বা কাজু নয়, শিবু তপেশ মনোজ টুকু সকলেই ঘোর অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করলেও সমস্ত ঘটনায় তনয়ই তখনকার মতো কোনো কথা বলেনি।

মিটিং থেকে বেরিয়ে শুধু ও বলেছিল— 'একেই গণতান্ত্রিক অনুশাসন বলে ? এতে যে গণতন্ত্রও নেই, অনুশাসনও ভ্যানিশ। 'অনু' বাদ দিয়ে 'শাসন'
থুড়ি 'দুঃশাসন টুকুই শুধু আছে!'

ফিচেল তপেশ বলেছিল, 'কে বললে কী আছে আর কী নেই? আরে, ওর মধ্যেই সবই আছে। হ য ব র ল-র বেড়ালটার কথা ভুলে গেলি? বেড়ালটাকে বেড়ালও বলতে পারিস, রুমালও বলতে পারিস, চন্দ্রবিন্দুও বলতে পারিস। চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, আর রুমালের মা—সব মিলিয়ে চশমাও বলতে পারিস।'

অত কষ্টকর উত্তেজনার মধ্যেও তপেশের কথায় আমরা হেসে উঠেছিলাম। তরণী হাসতে গিয়ে ‘উয়াফ' করে বিষম খেয়ে টেয়ে একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড।

তনয় নাইট ইস্কুলের অফিসে ঢোকা বন্ধ করেছে। সাংগঠনিক কেন্দ্র হলো তার দপ্তর, সেখানে নিয়মিত হাজিরা দেওয়াটা নাকি রুটিন কাজের একটা, কিংবা ওদের ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়—মনোজের এইসব পরামর্শ ও শোনেনি। বলেছে – ' নামগুলো নিশ্চয়ই বড়োদের দেখানো হয়েছিল, অবনদাও নামগুলো দেখেছেন এবং অনুমোদন করেছেন ? আসলে কারা কারা কমিটিতে থাকবে সেটা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারা কারা বাদ যাবে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ! গোটা ব্যাপারটাই সলিলে সমুদ্র।'

টুকু বুদ্ধিমতী। ও সেদিনের এতসব কথার মধ্যে না গিয়ে আবার প্রশ্ন করল— 'কী করবে?'

আমি হাসলাম—'যা করছি।'

'কী করছ?'

'এই যে তোমাকে দেখছি খুব মনোযোগ দিয়ে।'

টুকু শাড়ির আঁচলটা একটু গুছিয়ে নিল। খুবই অপ্রতিভ লজ্জারুণ ভঙ্গি তার। বলল—'কথা ঘুরিও না।'

আমার চোখে স্বপ্নে দেখা টুকুর পাহাড়ী ঝর্ণার ধারে বাংলোর লনে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিটি ভেসে ওঠে। আমি বলি — 'সবই করব টুকু, নিজে পড়ব, নাইট ইস্কুলে পড়াব, সবই করব। কারোর মুখ চেয়ে তো আর নাইট ইস্কুলে যাই না, যাই ঐ যে কী বলে — মতাদর্শের জন্য। কারোর জন্য তাই ছাড়বও না।'

'দাদা কিন্তু ' আমি টুকুর কথায় বাধা দিই— 'আমি তনয়কে বোঝাবো, সে তুমি ভেবো না। কোনোকিছু নিয়ে ভেবেই নিজেকে কষ্ট দিও না।'
 
'তুমিও তো আমাকে কত কষ্ট দাও।' টুকু ঘাড় বেঁকিয়ে নদীর দিকে তাকায়।

কুন্তীর বুক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বয়।

সেই বাতাস গায়ে মেখে আমি বলি – 'কোনো কিছু নিয়েই কষ্ট পেও না, খুব পরিকল্পনা করে কিছু করার সুযোগ আমাদের মতো পরিবারের ছেলেমেয়েদের নেই টুকু। কিন্তু যা করব, তোমাকে সঙ্গে নিয়েই করব।' এই সময়েই ঘাটের ওপর পিটুলি গাছটার পাশ দিয়ে তনয় আর কাজু দেখা দেয়।

কাজুর পরনে সবুজ-হলুদ পাতা ছাপ শাড়ি। বিপরীত দিকের ঢাল বেয়ে উঠছে ওরা। আমি টুকুর হাতটা ধরে ছোট্ট একটু চাপ দিয়ে ছেড়ে দিই। কাজুরা এগিয়ে আসছে।

তনয়ের চোখ কুন্তীর দিকে। কাজু সোজা আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। কাজুর চলাফেরা, ভাবভঙ্গির মধ্যে বরাবরই এক ধরনের ঔদ্ধত্য আছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কাজু অতি সরল, একটু বোকাও। পাশ করলেও আমাদের সকলের মধ্যে কাজুর রেজাল্টই সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। এমন কী আমাদের তরণীর থেকেও। কিন্তু তা নিয়ে কাজুর কোনো সংকোচ বা তাপ-উত্তাপ নেই। পাশ করেই ও আহ্লাদের সাগরে ভাসছে।

'তুমি যে লজ্জায় চোখই তুলতে পারছ না।' তনয়ের দিকে তাকিয়ে কাজু ঠোঁটের কোণে হাসে।

ব্যাপারটা কি ঠিক হচ্ছে কাজু? সংশয়ী শোনালো তনয়ের গলা।

'আহা! আমরা যথেষ্ট বড়ো হয়ে গেছি।' কাজুর গলায় জেদ।

'তবু এমন লুকিয়েচুরিয়ে..'

'চিরকালই এসব লুকোনো থাকে।'

'তা-ও, এমন চুরি করে...'

'কে কার ওপর চোট্টামি করল?' কাজু হাসছেই— 'আরে বাবা, তুমি তো কিছু করোনি! চোট্টামি বলো চোট্টামি, ডাকাতি বলো ডাকাতি, সবই তো আমি করেছি, তোমার ভাবনা কী?'

এত কাছে এসে পড়েছে কাজু আর তনয় যে, ওদের সব কথা স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমরা। কী চুরি? কোন্ ডাকাতির কথা বলছে কাজু। 

টুকুর মুখে রক্ত চলকে উঠল। আমার মনে হলো নদীর ওপারের কৃত্রিম অরণ্যের রোগা ঢ্যাঙা গাছগুলো যেন আজ আমাদের দেখে নিচ্ছে।

'হাবা কোথাকার! আস্তে চলো না, রাস্তা ফুরিয়ে যাবে যে।' চাপা গলায় ধমক দেয় কাজু।

কুন্তীর দুই পাড়েই এখন গভীর নির্জনতা।

তনয় চোখ ফিরিয়ে তাকায় তার পাশে চলা কাজুর দিকে, কাজুর মুখে বৈকালিক সূর্যের সোনালি রক্তাভা। এই রোদ-মেশানো ছায়ার জাফরির মধ্যে তনয় তরুণ সূর্যদেবতার মতো হেঁটে আসছিল। তনয়ের পাশে কাজুকেও আজ স্বর্গ, সূর্য, সুখ, আলো আর সত্যের দেবী মারীচির মতো দেখাচ্ছে। একটু অপ্রতিভ, কিন্তু অতিমাত্রায় উজ্জ্বল সেই মুখশ্রী। আমাকে আর টুকুকে দেখে কাজুর বড়ো বড়ো আঁখিপল্লব নেমে আসে। অতি ভীরু, স্পর্শোন্মুখ, অতি গভীর, সম্পূর্ণ অনাঘ্রাত। আমরা সকলেই কুন্তীর কোলের কাছটিতে মাটির সান্নিধ্যে বসে পড়ি। 

মাটি—আশ্রয়ের অপর নাম।

কুন্তীর দিক থেকে দমকা বাতাস বয়। কাজু আর টুকুর খোলা চুল উড়িয়ে দেয়, আমার আর তনয়ের যেমন-তেমন ন্যাতানো জামা সেঁটে বসে গায়ে। খেয়াঘাট এখান থেকে বেশ খানিকটা তফাতে। এখান থেকেই আমরা দেখলাম মাধুকরী শেষে শেষ-বিকেলের আলোয় কুন্তীর জলে গা ধুয়ে আনন্দীদিদি 'মোকামে' ফিরে যাওয়ার পথ ধরেছেন। এখান থেকেও বেশ বোঝা যায় তাপিত মাটির বুকে ভেজা শাড়ি-সিঞ্চিত পায়ের জলছবি এঁকে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন।

মাধুকরীর ঝুলিটি এখন একটা পুঁটুলির আকার নিয়ে তাঁর মাথায় বিরাজ করছে।

অন্ন।

মেগে খাওয়া অন্নই নাকি তাঁর কাছে ঈশ্বর। বলেছিলেন আনন্দী দিদি। তখনকার মতো রবীন্দ্রনাথের বোষ্টমী আনন্দীর সঙ্গে আমাদের আনন্দী দিদির ভারি মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। কী জানি, হয়তো বোষ্টমীর মতোই আনন্দী দিদির পূর্বাশ্রমের জীবনেরও কোনো গল্প আছে!


অনন্যবর্তী 
দুর্লভ সূত্রধর 

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা 
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।