শেষ মৃত পাখি। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শহরের বহির্ভাগ এগিয়ে আসছে। চারপাশে লোকজন কম। ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে শুধু আশেপাশের দোকানের আলো। কুয়াশার মধ্যে কোথাও কোথাও জটলা এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। বাকি জায়গাটা ফাঁকা এবং অস্বচ্ছ অন্ধকার। অনুমান করলাম, ভিড়ের জায়গাগুলো হোটেল, পাব অথবা রেস্তোরা। এই শহরে বর্ষার নির্জনতায় যখন রাত্রি নামে, নির্জন হোটেলদের ধ্বংসস্তূপ আর পলিথিনের কম্বলে ঘুমিয়ে থাকা জিপগাড়ির দল যখন গুটিয়ে ফেলে নিজেদের, তখন মনে হয় পাহাড়ের আদিম হিমশীতল জঙ্গল এসে দখল নিচ্ছে গোটা জায়গাটার। মনে হয়, এই অবিশ্রান্ত ছিপছিপে বৃষ্টির থেকে পরিত্রাণ নেই।

জলাপাহাড়ের রাস্তা দিয়ে সাবধানে গাড়ি উঠছে। কুয়াশা এখন কম। হয়তো ওপরে উঠতে সময় নিচ্ছে। আশেপাশে অভিজাত মহল্লা। জিপিএস খুলে দেখলাম, আর চারশো মিটার। অধিকাংশ বাড়ির সামনে বাগান। লনে আলো জ্বলছে। দু-একটা হোটেল। বাড়িগুলির গড়ন পুরোনো ব্রিটিশ উপন্যাসকে মনে করিয়ে দেয়। মদনদাকে জিপিএস দেখে রাস্তার নির্দেশ দিতে দিতেই চোখ তুলে দেখলাম, বৃষ্টিভেজা নির্জনতার মধ্যে একটা নিঃসঙ্গ ছায়ামূর্তি পাহাড়ের ওপরের ধাপে দাঁড়িয়ে আমার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ চোখ কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর রেনকোট পরা। মাথায় হুড চাপানো। মূর্তিটা নিস্পন্দ ভাবে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু বুঝতে পারছি তার দৃষ্টি অনুসরণ করছে গাড়িকে। গাড়িটা মূর্তির সমান ধাপে উঠল। মূর্তিটা আস্তে আস্তে মুখ তুলে গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকল। এখন গাড়ি আর মূর্তিটা একই সমতলে, পঞ্চাশ মিটার মতো দূরত্বে দাঁড়িয়ে। মুখ এখনও দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, তাই লোকটার পুরো চেহারাটাই কালো একটা অবয়বের মতো লাগছে। গাড়িটা আর একটা বাঁক ঘুরল। পেছন ফিরে তাকালাম। শুধু আবছা কুয়াশা। আর কিছু নেই। মদনদা গাড়ি থামালেন। সামনে একটা বড়ো ফটক। তার গায়ে ইংরেজিতে লেখা 'চৌধুরী ভিলা'।

এগিয়ে এসে চোখকে ধাতস্থ করতে হলো। ভেতরে প্রশস্ত বাগান পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে। বাগানের ভেতর আলো জ্বলছে। গাড়ির শব্দ শুনে সিকিউরিটি এসে গেট খুলে দিচ্ছে। ঘড়ঘড় শব্দ করে দুই দিকে হাঁ হয়ে গেল পুরোনো লোহার ফাটক। বাগানের ভেতর দিয়ে পায়ে হাঁটাপথ এঁকে বেঁকে উঠে গিয়েছে একটা দোতলা বাড়ির কাচের দরজায়। দরজার পাশে প্রশস্ত ফ্রে উইন্ডো। বাড়ির পুরোটাই কাঠের। তার ওপর পোড়ামাটির রঙের একটা এফেক্ট আনা হয়েছে। দোতলার মাথায় টালি। বিভিন্ন অর্কিড, লতাপাতা দিয়ে সাজানো। একটা চিমনি উঠে গেছে তার মধ্যে থেকে। বাড়ির একপাশে লাগোয়া আর একটা ছোটো টালির চালওয়ালা একতলা বাড়ি। সম্ভবত গেস্টহাউস। বাগানের ডানদিকে একটি ছাউনির নীচে গা এলিয়ে পড়ে আছে ঝকবাকে হন্ডাসিটি। সম্পূর্ণ ভিক্টোরিয়ান পরিবেশের মধ্যে গাড়িটাই যা বেমামান। হয়তো মনে মনে আশা করেছিলাম যে পুরোনো দিনের ল্যান্ডরোভার বা নিদেনপক্ষে ফিয়াট দেখতে পাব।

এটাই সেই বাড়ি। বিখ্যাত লেখক অরুণ চৌধুরীর বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই চুয়াল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন প্রতিশ্রুতিবান সাহিত্যিক অমিতাভ মিত্র। দুই দিন পরে তাঁর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়। যে হত্যারহস্যের সমাধান আজও হয়নি।

শেষ মৃত পাখি
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্যঃ ৫২০ টাকা 

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।