শৈব্যা কথন। জয়া মিত্র।
"সেই অন্ধকারেও শ্মশানে একটি নির্বাপিতপ্রায় চিতা জ্বলছিল। তার পার্শ্বে দণ্ডায়মান মনুষ্যমূর্তি অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমার কণ্ঠ থেকে কোনো কাতর স্বর নির্গত হয়ে থাকবে, সে অতি কর্কশভাবে বলে উঠল— কে ওখানে? মনুষ্য হও বা প্রেতযোনি– এই গঙ্গাতীরের শ্মশানে আমার অধিকার, আমার সমক্ষে এসো—
সে কোনো মৃতের শোকার্ত স্বজন নয়, শ্মশানধারী চণ্ডাল। অন্ধকারে স্থলিত চরণে তার দিকে অগ্রসর হয়ে নিজমুখে বললাম— ভদ্র, আমি অতি হতভাগিনী, নিজে পুত্রের মৃতদেহ নিয়ে এসেছি তার শেষ সংস্কারের নিমিত্ত।
মৃত সৎকারের কাজ করে করে হয়তো তার চিত্ত এমনই পাষাণ হয়েছিল যে আমার বাক্যে তার চিত্ত কিছুমাত্র দ্রবীভূত হল না। অতি পরুষ ভাবে সে বলে উঠল— দুর্ভাগিনী হও আর সুভাগিনীই হও শ্মশানের কড়ি দাও, আমি দাহকার্য সমাধা করে দেব।
আমার মস্তকে যেন কঠিন আঘাত লাগল। এতক্ষণ ছিল শুধু অন্তরের মহাশোক, এখন এই ব্যবস্থার সামনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। কোনোদিন মৃত্যু কি শ্মশান অভিজ্ঞতা নেই যার সে কী করে জানবে শ্মশানের কড়ির কথা? কড়ি কোথায় পাব আমি? এক লহমা বুঝি মনে হল পদ্মমাধব জানে এ কথা, তবু সে পাশে থাকল না, সে বলেছিল— বসে থাকো যতক্ষণ না তোমার পুত্রের দেহ ঘিরে শিবাদল আসে---
আমি তবে এখন কী করব? এই চণ্ডালকে কী করে বোঝাব?
'হে চণ্ডাল, আমি কারও দাসী, আমার কাছে কোনো সংস্থান নেই। অঙ্গবস্ত্রটি ব্যতীত কিছুই আমার নেই, তুমি দয়া করে আমার পুত্রের সৎকার করো।'
বিদ্যুৎ চমকে তাকে অতি ভীষণ দেখতে লাগছিল। শ্মশ্রু ও কেশমণ্ডিত মূর্তি যেন সাক্ষাৎ যমদূত, সে ভয়ংকর কর্কশভাবে উত্তর করল— শুল্ক না দিলে কোনো সৎকার হয় না। তাহলে অঙ্গবস্ত্রই দিয়ে যাও। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। নির্মম চণ্ডালের এই অপমানবাক্যে বুঝি শৈব্যার সর্বস্বহারা দুর্ভাগ্যকে এক চূড়ান্ত সীমায় উপনীত করে দিল। আমি ভূমিতে পড়ে হা হা করে কেঁদে উঠলাম--- হায় বৎস রোহিতাশ্ব! তুমি কেন গেলে? এই লাঞ্ছনা থেকে শৈব্যাকে আজ কে রক্ষা করবে? মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে মিশে অতি উচ্চ আর্তনাদ বজ্রধ্বনিপ্রায় বেজে উঠল:
কে? কে তুমি? কাকে দাহ করতে নিয়ে এসেছ?"
শৈব্যা কথন
জয়া মিত্র
প্রচ্ছদ: মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য: ১৬০ টাকা
#সুপ্রকাশ
ছবিঋণ: আন্তর্জাল
Comments
Post a Comment