নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

সারাবছর বিদেশে কাটাইয়া পূজার ছুটিতে যেদিন বাড়ি আসিলাম, সেদিন শারদীয়া শুক্লা তৃতীয়া। আমার কার্য্যস্থান হইতে বাড়ি আসিতে হইলে একটা নদী পার হইতে হয়, এই নদী পার হইয়াই আমাদের গ্রাম।

অন্যান্য বারের ন্যায় এবার আমাদের এই নদীতে বেশি বান হয় নাই, জল অল্প বাড়িয়াছিল, এখন শুকাইয়া যাইতেছে। দূরবর্তী পদ্মাতীরে থাকিয়া নদী সম্বন্ধে আমার ধারণাটা কিছু প্রশস্ত হইয়াছে। বর্ষার সেই বিশালকায়া, পঙ্কিলতোয়া, কলগামিনী, কামচারিনী, পর্বতনন্দিনীর ক্রোড়দেশে কালাতিপাত করিয়া তাহার এই ক্ষুদ্র শাখাটিকে আর নদী বলিয়া ধারণা হয় না। তথাপি এই ক্ষুদ্র তরঙ্গিনী আমাদের গ্রামের নদী, আমরা আবাল্য তাহার সহিত পরিচিত, এখনো মনে পড়ে কতদিন আমরা সকাল সকাল পাঠশালা হইতে পালাইয়া এই নদীর জলে বাল্যসাথীগণের সঙ্গে মাতামাতি করিতাম, এবং বৈশাখের বৈকালে ঝড় উঠিলে পাঁচ সাত বন্ধুতে একত্র হইয়া পরিধান বস্ত্র আজানু উত্তোলন পূর্বক ইহার সকুঞ্চিত জল পার হইতাম এবং বর্গীর হাঙ্গামার মতো ওপারের দত্তদের আমবাগানে ছুটিয়া পড়িতাম ।

সন্ধ্যাকালে যখন নদীর ধারে আসিয়া আমার গাড়ি থামিল, তখন সন্ধ্যা অতীত হইয়াছে ; তখন চন্দ্র পশ্চিম আকাশে অশ্বত্থ গাছের অন্তরালে নামিতেছিল, সেই ক্ষীণকায় চন্দ্রতনুর ম্লান জ্যোতি ক্ষুদ্র নদীর নিস্তরঙ্গ বক্ষ, দূরান্তরন্য আম কাঁঠালের বাগান, সবুজ মাঠ এবং স্থানে স্থানে সমাকীর্ণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিবিড় গুল্মের উপর পড়িয়া স্তব্ধ প্রকৃতির মধ্যে একটা মোহন মায়াচিত্র প্রস্ফুট করিয়া তুলিতেছিল।

নদী পার হইয়া ঘনসন্নিবিষ্ট তেঁতুল গাছের মধ্যবর্তী মেঠো পথ ধরিয়া আবার গাড়ি চলিল । দুইদিকে প্রচুর বৃক্ষসমাচ্ছন্ন বাগানে পুঞ্জীকৃত খদ্যোত ক্ষীণ আলো বিকীর্ণ করিতেছিল, পথের উপর, ঘন বনের মধ্যে ঝিল্লিদলের অশান্ত শব্দ; এই খদ্যোত-খচিত ঝিল্লিমুখরিত পথ শেষ হইলেই আমাদের বাড়ি।

রাত্রি নটার সময় বাড়ি আসিলাম। আমাদের পল্লীগ্রাম— বাড়ির চারিদিকে কতরকমের গাছ ; কোনো দিকে নারিকেল ও সুপারি গাছের সারি, কোনো দিকে আমড়া, সজনে, ডুম্বুর গাছে ঘেরা বেড়, বাগানের মধ্যে জাম পেয়ারা ও বাতাপি লেবুর গাছ, লিচুর কলম, গোলাপ জাম ও নারিকেলা কুলের চারা এবং তাহারই অদূরে গহ্বরস্থ সতেজ সরস কচুবনের উপর শাখাবাহু বিস্তার করিয়া বিস্তর নোনা আতার গাছ বিশৃঙ্খলভাবে অবস্থান করিতেছে, ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সেই সক্কল গাছে নোনা পাকিলে দিনের বেলা তাহাদের উপর পাড়ার ছেলেদের এবং রাত্রিকালে দেশের বাদুড়ের উৎপীড়ন চলে। এখন আর অন্য ফল দেখিবার যো নাই, কেবল একটা ছোটো জলপাই গাছে থোকাকত জলপাই, আর লেবু গাছে গোটাকত বাতাপি লেবু ফলিয়া আছে, এবং সকল গাছগুলিই বর্ষার নবজলধারায় পরিপুষ্ট দেহে গাঢ় শ্যামল যৌবনশ্রী ধারণ করিয়া প্রচুরোদ্গগত পত্র পল্লবে সবল ঘন আলিঙ্গনে আবদ্ধ হইয়া পরম পুলকে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং গোয়াল ঘরের পাশের একটা কামিনী ফুলের গাছ হইতে সদ্যবিকশিত পুষ্পস্তবকের মৃদুগন্ধে মধ্যে মধ্যে রাত্রির এই তরল অন্ধকার ভরিয়া উঠিতেছে। চারিদিকে পল্লীবাসিনীদিগের চিড়া কুটিবার ধুপধাপ শব্দ, রাত্রি ক্রমে অধিক হইয়া আসিল, কিন্তু এ শব্দের বিরাম নাই, ষষ্ঠীর পর হইতে লক্ষ্মীপূজা পর্যন্ত আর ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার নিয়ম নাই, তাই রমণীগণ পূর্ণ হইতেই ঢেঁকির কাজ সারিয়া রাখিতেছেন, লক্ষ্মীপূজার সময় সকলের বাড়িতেই চিড়ার বিশেষ দরকার, যাহারা সুবিধা অনুসারে চিড়া বিক্রয় করে, তাহাদেরও এই সময় চিড়া কোটা লাভজনক। তাই সকল বাড়িতেই সবেগে ঢেঁকি চলিতেছে, এবং ষষ্ঠী যতই নিকটবর্তী হইতেছে ততই বেশি রাত্রি পর্যন্ত ঢেঁকি পড়িতেছে; পঞ্চমীর দিন দিবারাত্রি আর ঢেঁকির বিশ্রাম ঘটে না।

রাত্রি প্রভাত হইলে গ্রাম্য বাজারের দোকানগুলি উন্মুক্ত হইতে লাগিল। বাজারে যে তিন চারি খানি মনোহারী জিনিসের দোকান আছে, পূজা উপলক্ষে সেই সকল দোকানে নানারকম জিনিসের আমদানি হইয়াছে; দেশি ও বিলাতি ছবিতে দোকানের দেওয়ালগুলি ঢাকা, ঘরের খুঁটাতে ছোটো ছোটো পেরেক পুঁতিয়া তাহাতে জরিমোড়া টুপি সাজানো, চাষারা তাহাদের ছোটো ছোটো ছেলেদের জন্য এই টুপি কিনিয়া থাকে। কাচের আলমারির মধ্যে ধোয়া কামিজ, লাল সবুজ গর্ণেটের মেয়েদের বডিস। দোকানের ঠিক মধ্যস্থলে কাচের ল্যাম্প, চিমনি, কাচের গ্লাস, আয়না, ছোটো বড়ো নানা আকারের পুতুল, কাগজে বাধা ছ-গাছা করিয়া ছোটো বড়ো সাদা কালো বেলোয়ারি চুড়ি, চিনে মাটির ডিশ, পেয়ালা, হাড়ের দামাট লাগানো ছুরি, দুই একটা নলক-নাড়া টাইমপিস ঘড়ি, সাদা, লাল, হলদে লেবঞ্জুসে পরিপূর্ণ সাদা বোতল যথাক্রমে সজ্জিত। তাহাদের সম্মুখে ছোটো ছোটো ছুরি, কাঁচি, সাবান, ফিতে, চিরুণী, মানিব্যাগ, দোয়াত, কলম, পেন্সিল প্রভৃতি জিনিষে পরিপূর্ণ গ্লাসকেশ,  এক কোণে ছড়ি, ছাতা, আর একপাশে লাল, কালো, হলদে, সবজে পোর্টমেন্ট। সকাল বেলা হইতে দোকানে ক্রেতার ভিড় লাগিয়া গিয়াছে। ছেলেরা মার্বেলের ভেটা কিনিতেছে, কোনো কোনো বালক লুব্ধ দৃষ্টিতে লেবঞ্জুসের বোতলের দিকে চাহিয়া আছে, কোনো প্রবাসী প্রণয়ী প্রিয়তমার জন্য সাবান পমেটম কিনিতেছে, দোকানদার ক্রেতার মনের আবেগ ও অবস্থা বুঝিয়া যথেচ্ছ লাভ রাখিয়া জিনিস বিক্রয়ের প্রলোভন ত্যাগ করিতেছে না; কেহ ‘নলদময়ন্তী' ও ‘রামরাজা' ছবির দর করিতেছে, কোন পিতা পুত্রকে সঙ্গে লইয়া তাহার জন্য একটা কামিজ বা একজোড়া মোজা কিনিবার চেষ্টায় আছেন।

পূজার ছুটি
দীনেন্দ্রকুমার রায়

আসছে নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।