শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

রাগে গনগনে মাথা নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে রামশরণ বুঝল, বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে শীতটা। গায়ের একটা চাদরে বশ মানছে না ঠান্ডা। ভিতরে গরম কিছু পরা উচিত ছিল। রাতের রান্না চাপিয়ে দিল গজগজ করতে করতে। মেজাজটা খিটকে থাকার জন্যই বোধহয়, রান্নায় স্বাদ হলো না তেমন। আরও খিটখিটে মেজাজ নিয়ে খাটের কোণা থেকে লাঠি, বাঁশি নিয়ে তোড়জোড় শুরু করল বেরোনোর। টর্চটা জ্বালিয়ে একবার ফ্যাকাশে দেয়ালে ফেলে দেখে নিল ব্যাটারির জোর কতটা আছে এখনও। ঝুল পড়া দেয়ালের তাকে সাজিয়ে রাখা ছবির দিকে তাকিয়ে একবার মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলল, “জয় সিয়ারাম।”

সেই কবে বাবুজির হাত ধরে বিহারের কোন এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে চলে এসেছিল এই শহরে রামশরণ। ডাক্তারবাবু তখন গদিতে এই রাজ্যে। গরীব আদমির দল সরকারে আসতে ঢের বাকি তখনও। তবুও সেই দলেরই একজন মাথা টাইপ নেতার হাত ধরে চৌকিদারের চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিল তার বাবুজি। বাবুজির এই চৌকিদারির চাকরিতেই তাদের রুটি তরকারি ছাতু লিট্টি হয়ে চলে গেছে বেশ। তারপর বাবুজি চলে যাওয়ার পর আর এদিক-ওদিক না ভেবে, ওই কাজেই ঢুকে গেছে সে নিজেও। সেই থেকে দিনে দিনে কত স্লোগানই না শুনলো রামশরণ! ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়’ থেকে শুরু করে ‘পুলিশ তুমি যতই মারো’। নানা সুরে ‘ইনকিলাব’-ও শুনলো। তারপর বয়স বাড়তে বাড়তে যখন প্রায় তিন কুড়ির কোঠায়, তখন শুনলো জমি নিয়ে লড়াইয়ের স্লোগানও। আর এখন তো তারপর থেকে কয়েক বছর মাত্র কেটেছে, আর রাস্তা-ঘাটে অলিতে-গলিতে মিছিলের স্লোগানে কানে আসছে ‘জয় শ্রী রাম’।

তা বিশেষ মন্দ লাগে না ওর। সহজ সরল ব্যাপার। পথে চলতে ফিরতে একটু উপরওয়ালার নাম তো শোনা হয়। রোজ বিকেলে দেশোয়ালি লছমনের চায়ের দোকানে বসে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলতে বলতে কানে আসে শ্রী রামচন্দ্রের নাম। তা খারাপ কী! কিন্তু ডাকের ধরণটা কেমন একটা অন্যরকম যেন, ভাবে রামশরণ। কেমন যেন একটা খুনে খুনে ভাব। অবশ্য সে যাই হোক না কেন, সেদিনের সেই বখাটে লফঙ্গে টাইপ নাড়ু বা বিবেকের মতো ছেলেপুলেদের গলায় ভগবানের নাম তো তবু আসছে! এই করেই যদি একটু-আধটু পুণ্য-টুণ্য আসে বা ধম্মে-কম্মে মতি হয়, তাহলে খারাপ কী— মনে হয় রামশরণের।

আর খারাপ কথাও তো তেমন কিছু বলে না! চারপাশে যা চলছে, তাতে জাত-ধরম টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে উঠছে সত্যিই। বেজন্মার জাতগুলো ভিন দেশ থেকে এসে ভিন ধর্মের কারবার খুলে বসেছে যেন! সত্যিই তো, যে হারে আন্ডা-বাচ্চা পায়দা করে চলেছে, তাতে দু’দিন পর নিজেদের ছেলেপুলেরা কী কাম-কাজের গতি করবে, তা রামই জানেন!

একটা গরম শ্বাস পড়ে। নিজের ছেলেটার কথা ভেবেও বড় চিন্তা হয় রামশরণের। বড় সাধ করে মা-মরা ছেলেটার নাম রেখেছিল কানাইয়া। রামশরণ খুব চেষ্টা করলেও, পড়াশোনায় কোনোদিনই বিশেষ মতি ছিল না ছেলের। তবু দু-একটা কাজের চেষ্টা যে করেনি, তা নয়। কিন্তু কাজ চাইলেই কাজ দিচ্ছে কে? ওই অগুনতি বেজন্মা আন্ডা-বাচ্চাদের দৌলতে নিজেদের ছেলেপুলেদের জন্য আর কাজ কোথায় এখন?

জাগতে রহো
শুভদীপ চক্রবর্তী

আসছে শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।