অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর
টুকু বাড়িতে আজ কচি কলাপাতা রঙের একটা ফ্রক পরে আছে, দুই বিনুনি করা চুল। মনে হয় গতকাল বিকেলে এই বেণী-দুটো রচিত হয়েছিল। তাই এখন শিথিল, কয়েকটা খুচরো চুল ওর কপোলে ওড়াউড়ি করছে। ভারি অদ্ভুত লাগে আমার। এই টুকু সবসমেত, সবটুকু নিয়ে আমার!
তনয় আমায় পড়ার ঘরে বসিয়ে স্নান করতে যায়। টুকুর দেখা পাই না। টেবিলের ওপর থেকে হাতের সামনে থাকা যে বইটা তুলে নিই সেটা খুলতেই টুকুর হাতের লেখা একটা চিরকুট দেখতে পাই। যদিও অনুচিত তবু প্রবল কৌতূহলে চিরকুটটায় চোখ বোলাই। —'কেন এত অনন্ত বিষাদ।' এসব কেন লিখেছে টুকু ?
এটা কি কোনো কবিতার চরণ? এটা কেন পড়ার টেবিলে লিখে রেখেছে টুকু?
তনয় স্নান করে আসে, টুকুও আমার জন্য চা আর মায়ের ভাণ্ডার থেকে ডালের বড়া সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। আমি বুঝি—এই সময় সংযোগ টুকুর স্বনির্বাচিত।
আমি মনে মনে তারিফ করি ওর বুদ্ধির। নইলে কী জানি— বাবার শটিভাঙায় যাওয়া, কৃষ্ণাদির স্বেচ্ছা-নির্বাসন... প্রতিটি সকাল আসে বিমর্ষ হয়ে, প্রতিটি সন্ধ্যা আলোহীন ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে থাকে।
একাই কুন্তীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকি।
ইটভাটার মাটির স্তূপের ওপর বসে ভাটার মজুরদের নিরন্ধ্র ইটচালার ঘরকন্না দেখি।
পড়ায় মন বসে না।
লেখায় মন বসে না। হয়তো শূন্যতার এই বোধ মুদ্রাঙ্কিত হয়ে থাকে দেহে, মুখেও।
তনয় এবার আর ছাড়ে না। বিকেলে ও আর কাজু মিলে খেয়াঘাটের উঁচু ধাপিতে আমাকে পাকড়াও করে। কাজু ওর স্বভাবসিদ্ধ প্রাবল্য নিয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর।
কী ব্যাপার, তোর পাত্তা নেই। এখানে একা এসে বসে আছিস। তোদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ হয়ে গেল, তোর দেখা নেই। কী ভেবেছিস তুই?
'ভাল্লাগে না।' আমি ঘাড় গোঁজ করে বলি।
কাজু এবার তনয়ের দিকে ফেরে — 'কী গো, আমাকে যে নিত্যি জ্ঞান দাও, ভালো না লাগাটা একটা অসুখ, তা নিজের বন্ধুকে সেটা বললেও তো পারো।' তনয় বলে—'ওকেও বলেছি, কিন্তু শুনছেটা কে? ও নিজেই তো সব জ্ঞানের খলিফা!'
'দেখ শোভন, আমায় রাগাস না বলছি। ওঠ, শিগগির ওঠ বলছি।' কাজু চেঁচায়।
'দিব্যি বসে আছি, কোথায় যাবো শুনি!'
'কোথায় তোর জানার দরকার কী? আমরা বন্ধু, তোকে যদি চোখ বেঁধেও কোথাও নিয়ে যাই, তো যাবি।' কাজু এবার হাত ধরে টানে।
কাজুর মোটা বিনুনিটা দুলছে। কোমর হেলিয়ে বসে থাকা আমার হাত ধরেছে ও। পাশে তনয় ওর রোগা-ঢ্যাঙা শরীর নিয়ে মাজা বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।
কাজুর এই আত্যন্তিক আগ্রহ আমাকে যেন জাগিয়েই দিল। আমি বহুদিন পরে কাজুর বিনুনিতে একটা ছোট্টো টান দিলাম।
'ওহ্!' অস্ফুট শব্দ করে কাজু আমর সামনেই ধপ করে বসে পড়ল— 'অ্যাই, তুমি ওর সঙ্গে বোসো তো, আমি ওকে একটা ম্যাজিক দেখাই। কাজু বলল তনয়কে। তারপর রাস্তার দিকের ঢাল বেয়ে সটান নেমে চকিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।'
অনন্যবর্তী
দুর্লভ সূত্রধর
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩২০ টাকা
#সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment