অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

শহরের বৈকালিক কোলাহল এড়িয়ে তাঁরা কুন্তীর পাড়ে এসে দাঁড়ালেন। খেয়াঘাটে দু-চারজন ভ্রমণপিয়াসীর আনাগোনা। তাঁরা পশ্চিমদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। অনেকটা হেঁটে যেখানটায় এলেন, সেখানে উঁচু মাটির বাঁধ। এটা নিচু এলাকা। বর্ষাকালে যাতে না ভাসে তার জন্য বাঁধ, বাঁধের মাঝ বরাবর একটা কালভার্টের মাঝখানে ছোটোমাপের স্লইস গেট। বর্ষার সময়টা বন্ধ থাকে। বাঁধের ওপরে সিমেন্টের বেঞ্চ গোটাকয়।

তাঁরা পাশাপাশি বসলেন। কুসুমিতা সংকুচিত। জড়োসড়ো হয়ে বসেছেন, তাঁর মাড় দেওয়া ইস্ত্রি শাড়িতে খস্থ আওয়াজ উঠল। শচীপ্রসাদ কুম্ভীর বিলম্বিত স্রোতের দিকে তাকিয়ে বললেন – 'আজ, এতদিন পর একসঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে তোমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, না?' কুসুমিতা বললেন—'খুব। কী লজ্জা!'

'অনভ্যাস। যাঁরা প্রায়ই একসঙ্গে কেনাকাটা করতে যান, বেড়াতে বেরোন, একই অফিসে হয়তো কাজ করেন, তাঁরা কী লজ্জা পান? পান না। কেন বলো তো?'

কুসুমিতা জবাব হাতড়াচ্ছিলেন। শচীপ্রসাদ বললেন— 'অভ্যাস। কুসুমিতা, তুমি অনভ্যস্ত। টুকু তোমার মেয়ে, তুমি ভাবতেই পারছ না যে সে বড়ো হয়েছে, তার নিজস্ব একটা হৃদয় হয়েছে, সে কাউকে একান্ত করে ভালোবাসবে—তুমি মা, অনভ্যাসহেতু তুমি তা মানতে পারছ না, তোমার সংকোচ হচ্ছে, লজ্জা হচ্ছে, রাগ হচ্ছে।'

এবার শচীপ্রসাদ অন্যদিকে গেলেন, বললেন— 'আচ্ছা, পঞ্চান্ন বছর আগে যখন তোমার ঠাকুমা-বাবা-মা তোমার নাম মোক্ষদা, দাক্ষায়ণী বা ক্ষেমঙ্করী না-রেখে শখ করে কুসুমিতা রেখেছিলেন, তখন কেউ কিছু বলেনি?' কুসুমিতা বললেন—“ওরে বাবা, বলেনি আবার! যে নামটা শুনত সে-ই হাসাহাসি করত, কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে বলত কালো মেয়ের নাম কুসুমিতা। আমাদের ইস্কুলের সেলাই দিদিমণি তো প্রত্যেকদিন বলতেন—'দেখিস, হাতে সূচ ফুটিয়ে ফুলের ঘায়ে মুচ্ছো যাসনে আবার, তুই তো আবার ফুলের মেয়ে!'

শচীপ্রসাদ হাসতে লাগলেন—'টুকুর নাম তো সুদক্ষিণা। এখন কেউ কি ওকে সে-নিয়ে ব্যঙ্গ করে। মাঝখানে কুসুমিতার মতো নামও বাতিল হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার ফিরে আসছে। কেন বলো তো—ঐ অভ্যাস। দৈনন্দিন অভ্যাসের মধ্যে না হলেই বেশিরভাগ মানুষ তাকে গ্রহণ করতে পারে না, নিজেই অস্বস্তি বোধ করে—নিজের ছাঁচটির মধ্যে সে নিরাপদ বোধ করে। কিন্তু তার জন্য পরিবর্তন তো আর থেমে থাকে না, সে নিজের পথ করে নেয়। সামনে চলার পথ খোলা পেলে সে এগিয়ে যায়, সেই পথ রুদ্ধ করে দিলে সে বেপথু হয়। মনে রেখো এতকালের মধ্যে আমি কখনও তোমার নামটাকে হেঁটে 'কুসুম' বলে ডাকিনি তোমায়।'

'কিন্তু অতটুকু মেয়ে টুকু, নিজের ভালো-মন্দের কী বোঝে?' কুসুমিতা বললেন।

শচীপ্রসাদ কুন্তীর জলে ভেসে যাওয়া একটি কলাগাছের ছিন্ন কান্ডের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, চট্ করে উত্তর দিলেন না।

'যদি ভুল করে টুকু, যদি কষ্ট পায়।' কুসুমিতার গলায় নির্ভুল উদ্বেগ। শচীপ্রসাদ বললেন— 'জীবনে চলতে চলতেই নিজের ভালো-মন্দ বুঝবে টুকু। পরের ভালো বুঝতে বুঝতেই নিজের ভালো বোঝাটা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। আর যদি ভুলই করে, দুঃখ পাবে দুঃখের মধ্য দিয়েই পথ করে নেবে জীবনের। কুসুমিতা, তোমার মেয়ে ভয়ানক বুদ্ধিমতী, স্বপ্ন-দেখা আলাভোলা ছেলে শোভনকে ও-ই চালিয়ে নিয়ে যাবে।' গাঢ় হয়ে এলো শচীপ্রসাদের স্বর।

নদীর এখানটায় একটা ভাঁজ আছে। তন্বী কুন্তী এখানে কোমরে একটি ভাঁজ ফেলে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে, এদিকে দশ মাইল দক্ষিণে তোমরখালিতে গিয়ে মিশেছে ঢুলাই নদীতে। কুন্তীর কোমরের ভাঁজ ছুঁয়ে বিকেলের গোধূলি আলোয় একটা নৌকো খাটো মাপের একটা পাল খাটিয়ে চলেছিল ঢুলাইয়ের দিকে। সেই নৌকার মাঝি কোনো একটা সারি গানের সুর ধরেছে, গানের কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু বাতাসের কম্পনে সুরটা ছড়িয়ে পড়ছে ওপারের ফসলের খেতে।

কুসুমিতার বুকের ভার নেমে গেল অনেকটাই। তবু একটা অনির্দেশ্য চাপ থেকে গেল যেন তাঁর হৃদয়ের কোণে।

অনন্যবর্তী
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা
#সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।