শৈব্যা কথন। জয়া মিত্র।

"সেদিন হঠাৎ মহারাজ স্বয়ং এলেন অবরোধে। তাঁর মুখে কোনো কথা ছিল না কিন্তু সেই মুখ রক্তবর্ণ, তাঁর ভ্রূ ঝড়ের আগেকার আকাশের মতো থমথম করছে। স্তন্যপানরত রোহিতাশ্বকে কোল থেকে নামিয়ে আমি ত্রস্ত উঠে দাঁড়ালাম। মহারাজ আমার প্রকোষ্ঠ নিজের করতলে ধরে দ্রুত পদক্ষেপে বাইরের দিকে রওনা হলেন। কী যেন আতঙ্কে আমার বুকে স্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠেছে, মহারাজের এই পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা আমার অভ্যাস নেই। আমার আঁচল স্খলিত  হয়েছে, চুল খুলে গিয়েছে, কোনো কিছু সংবৃত করে নেবার কোনো অবসরই আমি পাচ্ছি না। অজানা কোন এক ভীতিবশে আমি শুধু কোনোরকমে নিচু হয়ে রোহিতাশ্বকে কোলে তুলে নিয়েছি। অকরুণ অন্যমনস্ক রূঢ় আকর্ষণে চলতে চলতে মনে ভাবছি মহারাজ কি আমার প্রতি অপ্রসন্ন হয়েছেন। বিধান করেছেন দণ্ডাদেশ ? আমাকে কি নিয়ে চলেছেন ঘাতকের কাছে? কী অপরাধ আমার হয়ে থাকতে পারে, কেন শাস্তি হতে পারে এসব বিচার করবার কথা আমার মনেও আসেনি, কেননা এসব ক্ষেত্রে কোনো কারণ সন্ধান কেউ করে না। কেবল একটিই কথা ভাবছি--- আমি নারী, সহজেই ক্রোধ উদ্রেক করতে পারি, দণ্ডদানের যোগ্য বিবেচিত হতে পারি, কিন্তু রোহিতাশ— এই যে সুকুমার নবনীকোমল শিশু, একেও কি শাস্তি দেবেন মহারাজ ? এ তো তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকারীও। এসব কথা ভাবতে আমার কোনো সময় লাগেনি, বর্ষায় সরযূর তীব্র ধারায় যেমন একই সঙ্গে ভেসে চলে শত শত ফেনপুষ্প, তেমনইভাবে এই সকল ভাবনা আশঙ্কা ভীতি সব একসঙ্গে দ্রুতগতিতে আমার চিন্তার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল, কিন্তু বাস্তবকে কল্পনাও করতে পারেনি আমার শঙ্কা। সেই অবিন্যস্ত অসংবৃত বেশবাসে, নগ্নপদে মহারাজ আমাকে এনে দাঁড় করালেন প্রাসাদ-সম্মুখের বিশাল প্রাঙ্গণে। সেখানে তখন সহস্র লোকের ভিড়। তীব্র রৌদ্রতাপ। সেই গণনাহীন কৌতূহলী চক্ষুর সামনে মহারাজ স্বয়ং অতি রূঢ় হাতে আমাকে অনবগুণ্ঠিত করলেন। সমস্ত পৃথিবীর সামনে আমার ডান হাত ধরে সামনে ঠেলে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন— সেই শব্দ তপ্ত লৌহশলাকা দিয়ে আজও আমার সমগ্র অস্তিত্বে তীব্রতমভাবে চিহ্নিত আছে, দানবীর ধর্মপরায়ণ রাজা হরিশ্চন্দ্র নিজের ধর্মপত্নীকে ভিড়ের দিকে সামান্য ঠেলে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, এই সুন্দরী সালঙ্কারা শৈব্যাকে আমি বিক্রয় করছি। উপস্থিত জনতার মধ্যে কারও যদি দাসীর প্রয়োজন থেকে থাকে তিনি উপযুক্ত মূলা দিয়ে একে ক্রয় করুন।

উচ্চস্বরে স্পষ্ট উচ্চারণে তিনবার এই ঘোষণা করলেন তিনি, শৈব্যাকে আমি বিক্রয় করছি। সমবেত জনতার মধ্যে কি দীর্ঘশ্বাসের মতো অস্ফুটে কোনো 'হায় হায়' ধ্বনি উঠেছিল? সমবেত জনতার মধ্য থেকে কিছু মলিন বসনধারী মানুষকে কি দু'হাতে চোখ ঢেকে সেই প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম আমি? দেখেছিলাম কি অনেক পুরুষের দৃষ্টিকে আমার আবরণহীন মুখ কণ্ঠ বাহু যদৃচ্ছ লেহন করতে? এইসব কি সত্যি দেখেছিলাম? আমার মনে পড়ে না। আমার চক্ষু এইসব দেখতে বাধ্য হয়েছিল হয়তো, হয়তো তার কোনো কোনো অতি অপ্রধান অংশ স্মৃতি তার আপন শৃঙ্খলাবিহীন স্বভাবে গেঁথে রেখেছিল। অথচ বহু প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সে রক্ষা করেনি। কিংবা হয়তো সেইসব সংঘটনা বা অনুভূতি যথাযথ রক্ষা করা স্মৃতিরও ক্ষমতা বহির্ভূত ছিল। তাই আমি এখন আর সে মুহূর্তের অনুভুতিগুলি আপন বোধে ফিরিয়ে আনতে পারি না। ঘটনাগুলির ও অনুভূতির স্মৃতিমাত্র আছে, যেন তা আমার নিজের জীবনের ঘটনা নয়, অন্য কারও জীবনের।" 




শৈব্যা কথন
জয়া মিত্র

প্রচ্ছদ: মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য: ১৬০ টাকা
#সুপ্রকাশ

ছবিঋণ: আন্তর্জাল 




Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।