আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর।

কথা বলা প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে।

এটা ভালো লক্ষণ বোধহয়। তাছাড়া শুনবার লোক যে হারে কমে যাচ্ছে তাতে, এই একা-বোকাটা আর যাবেই বা কোথায়? কথাই বা আর কী বলবে? কাকেই বা বলবে? শোনার লোকই বা কোথায়!

আমাদের মণিবাবু স্যার বলেছিলেন— 'কথা বলার ইচ্ছে হলে মানুষকে বেশি ঘাঁটিও না বাপু। মানুষ শুধু নিজের কথা বলে, কেউ কারও কথা শোনে না! তার চেয়ে কিছু বলবার খুব ইচ্ছে হলে লিখে রাখো কল্প খাতায়, ভেড়ে যাওয়া পুঁথির পাতায়। আর যদি সে-সব কাছে না থাকে তবে তোমার কথা আকাশকে বলো। বাতাসকে বলো গাছপালাকে বলে রাখো।'

কিন্তু মুশকিল হয়েছে কী— আকাশ ব্যাপারটা বড্ড সুদূর, অত পর্যন্ত বামনের হাত পৌঁছবে না। তাছাড়া আকাশ মানে তো শূন্য থেকে মহাশূন্য শূন্যতার কাছে কিছু বলতে ভালো লাগে? ইদানিং আকাশেরও আর শোনার মতো ক্ষমতাও নেই, ওজোন স্তর ফুটো- টুটো হয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। বাতাস এত পল্যুটেড যে, তার কান আর চোখ দুটোই একেবারে গেছে। তাছাড়া যাকে দেখা যায় না, অথচ আছে বোঝা যাচ্ছে, তাকে কোনো কথা বলা মুশকিল। গাছের কাছে গিয়েও বলা যায়, কিন্তু গাছগুলো নিজেরাই এত অসুস্থ, কর্তনাশঙ্কায় সদাসর্বদা এত কম্পমান, যে তাদের কথা কে ভাবে তারই ঠিক নেই।

তবু কথায় কথা বাড়ে। আর বাড়ে চুল-দাড়ির ইন্দ্রজাল। তাই কেউ শুনলে ভালো, না শুনলে তো আরও ভালো। জীবনের দিগচক্রবাল ঘেঁষে যত খুদকুড়ো জমা হয়েছে সবই তো যাকে বলে- রস-কষ সিঙাড়া-বুলবুলি—শুধু মস্তকটাই নেই এই যা! আহাম্মকদের তো ওটারই অভাব। সব কিছু ‘গজাল মেরে গোঁজানো যায় না, আহাম্মকেরা তো শুধু পারার মধ্যে পারে জীবনের ফেলে দেওয়া খুদকুড়োগুলোকে জড়ো করে রাখতে।
গুস্তাভ্ ফ্লবেয়ারের কাছে ইডিয়ট হলো তারা— 'দোজ হু ডিফার উইথ ইউ।' চালাকেরা তাই সকলের সঙ্গে সহজেই সব বিষয়ে সহমত হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত আহাম্মকেরা ডিফার করার ঠেলা আছে জেনেও ফট করে ডিফার করে বসে, নিজের মতটা বলে বসে। — সকলের চক্ষুশূল হওয়ার ঠেলা সামলায়। কোথায় ফ্লবেয়ার আর কোথায় প্রকৃত আহাম্মকেরা ! ফুঃ !

তবে কী না স্নিকেট এর লেখা হলো গিয়ে ফিশনাল, গল্প-কাহিনী। এতকাল পরে এই খুদকুড়োগুলোও তো তাই-ই।

খুদকুড়ো জড়ো করা অবশ্য চাড্ডিখানি কথা নয়— গোটা গোটা চালের পুঁজি থাকলে তবে তো খুদের কদর। তাছাড়া আহাম্মকদের ভাঁড়ার সদাই বাড়ন্ত। উপরক্ত খুদের সঙ্গে ধুলো-ময়লা-ধান-কাঁকড় থাকে বিস্তর। সে এক সমস্যা।

আমাদের ডুমাটোলার দাদু বেশ কিছুটা অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন মায়ের কাকা। প্রায়ই ডুমাটোলা থেকে দেহাতি মানুষের ভিড়ে ঠাসা টেনে চেপে, কষ্ট করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলে আসতেন তাঁর ভাইঝিকে দেখতে। সঙ্গে কখনও বয়ে বয়ে আনতেন এক টুকরি আম, কখনও মাটির হাঁড়িতে জিয়ানো মাগুর মাছ, কিংবা বিশাল এক শিশিতে ভঁইসা ঘি— কিছু না কিছু একটা। মা রাগ করলে বলতেন, 'ওরে, এগুলো হাতে থাকলে আমার রেলগাড়ির কষ্ট অর্ধেক কমে যায়। তুই, আমার দিদিভাই, দাদুভাইরা খাবে এটা ভাবলে শক্তি পাই।' সেদিন এই শক্তির মর্ম বুঝবার শক্তি ছিল না।

ডুমাটোলার দাদু বলেছিলেন, 'বুঝলে দাদুভাই, এই জীবনটা ছাড়া জীবনে অপ্রয়োজনীয় বলে কিছু নেই। হমারা জীবন সির্ফ হমারা অকেলা নহি হ্যায়, সবারটা মিলিয়ে তবে আমাদের এক একটা জীবন। তোমার জমানো খুদকুড়োর মধ্যে দেখবে আছে কত লোকের জীবনের দিনরাত, কিতনে লোগো কো জীবিত রহনা। কতজনের কত কথার কত শব্দ, দিল কী বাত, কতজনের কত গান, বুদ্ধি কী কিতনা সুগন্ধ, বিচারো কা হীরা-জহরৎ। সোচো দাদুভাই, ইয়ে কেবল আপকি চিজে নহি হ্যায়— বলতে গেলে তোমারই নয়। তাই আলো ভালোগুলোকে আগলে রেখো। যেদিন দেখা যাবে খুদকুড়োও নেই, ফুটন্ত ভাতের গন্ধ নেই কোথাও, সেদিন হয়তো এগুলোরই খোঁজ পড়বে। কোনোকিছু অপচয় কোরো না। ইয়াদ রাখনা, অপনে দিলমে কোই তরহা কোই অপেক্ষায়ে রাখা চলবে না। অর ফির ইসকে লিয়ে অপনে আপ মে কোই অভিমান নহি রাখনা চাহিয়ে।

সত্যিই তাই, আহাম্মকটা ভাবে— আজও ঈশ্বর পাটনিরা দেবী অন্নপূর্ণার কাছে ধনরত্ন, ভোগবিলাসের সামগ্রী না চেয়ে তার সন্তানদের একটু দুধে-ভাতে রাখার জন্য প্রার্থনা করে চলেছেন! আমাদেরও তো শুধু ছিল সেই শেয়ালটা, জ্বরের মুখে অমৃতের মতো মায়ের রান্না করা পোড়ের ভাত— এইসব। সেই যে ভারতচন্দ্রের মালিনী মাসি এই জাতীয় কী একটা যেন বলেছিল, 'আছিল বিস্তর ঠাট প্রথম বয়সে / এবে বুড়া তবু কিছু গুঁড়া আছে শেষে'— এইরকম আর কী!

ভূমিকা। 

আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর। 

প্রচ্ছদ: সৌজন্য চক্রবর্তী

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।