দুর্লভ সূত্রধরের স্মৃতিগদ্য 'আহাম্মকের খুদকুড়ো' পড়ে লিখছেন গৌরব বিশ্বাস

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের স্মৃতিগদ্য ' আহাম্মকের খুদকুড়ো ' পড়ে লিখছেন গৌরব বিশ্বাস। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
.......................
একজন ব্যক্তি, যে ধরনের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, তাঁর লিখিত স্মৃতিকথনেও স্পষ্টতই তার ছাপ রয়ে যায়। যেমন ধরুন, অভিজাত ধনবান কোনো বিজনেসম্যান যদি স্মৃতিকথন লিখতে বসেন, তাঁর স্মৃতিকথনে উঠে আসবে-তিনি কটা দামী গাড়ি চড়েছেন, ক'বার বিদেশ সফরে গেছেন, সেখানে কী কী এক্সটিক ডিশ চেখে দেখেছেন, কোন কোন বিজনেস ডিল ক্র্যাক করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলোই তাঁর স্মৃতিকথনে উঠে আসা স্বাভাবিক।
কিন্তু এধরনের স্মৃতিকথন সুখপাঠ্য যদিও বা হয়ে থাকে, এ তো আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের কাহিনী নয়। প্ৰকৃত মধ্যবিত্তের জীবনস্মৃতি লেখা সহজ ব্যাপার নয়। 'মধ্যবিত্ত' এই সামাজিক স্ট্যাটাসটার সংজ্ঞা বারবার বদলেছে। এ যুগে মধ্যবিত্তের স্বরূপ ধরতে পারা মুস্কিল। বরং মধ্যবিত্ত বলতে যে শিক্ষিত , সীমিত ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী, জীবনের প্রায় সব ব্যাপারেই মধ্যম পন্থার অবলম্বনকারী, নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক অনুশাসনের ধারক- এমন এক শ্রেণীর মানুষদের বোঝাত, তেমন ব্যক্তির খোঁজ এ যুগে পাওয়া ভার। বরং প্রাক বিশ্বায়ন যুগে, আমাদের বাবা কাকা জ্যাঠা-যাঁরা সংসার ধর্ম পালনে ব্রতী হয়েছিলেন, তাঁরাই ছিলেন প্ৰকৃত মধ্যবিত্ত জীবন বোধের প্রতিভূ।
সুতরাং খাঁটি মধ্যবিত্তীয় জীবনস্মৃতি খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। আর দুর্লভ বাবু সে কাজটিই বড় সাবলীল ঢঙে করেছেন। সে মধ্যবিত্তীয় জীবনে কাঁচা পেঁয়াজ, তেল নুন লঙ্কা আর লেবুপাতা দিয়ে মাখা পান্তা ভাত আছে, জল খাবারে মুড়ির সাথে বেগুণী আর ডালের বড়া আছে, নবীন বাবুর ডালপুরীর সাথে ভুবনবাবুর জিলিপি আছে, বিজুরিয়ার সুকণ্ঠ আছে, মনিবাবু, সুধন্যবাবু, কানাইবাবুর মতো মাষ্টার মশাইরা আছেন।  ফেলে আসা দিনের এমনই সব খুদকুড়োদের নিয়ে দুর্দান্ত পরমান্ন রেঁধেছেন দুর্লভ বাবু।
এই বইটির একটি অধ্যায়ে, দুর্লভবাবু, তাঁর মায়ের ডিম রান্নার এক পন্থার কথা উল্লেখ করেছেন- মধ্যবিত্ত পরিবারে গোটা ডিম তো তখন কারও পাতে দেওয়া সে যুগে সম্ভব ছিল না। কিন্তু ডিমের অর্ধেকই যাতে সবাই সমান পায় তার জন্য সেদ্ধ ডিমকে সুতো দিয়ে লম্বা করে কাটা হত। আবার রান্নার সময় সেই খন্ডিত অংশ থেকে কুসুম যাতে খসে না যায়, তার জন্য আটা কিংবা চালের গুঁড়োর লেইয়ের প্ৰলেপ লাগিয়ে ভাজা হত। এই অংশ টুকু যখন পড়ছি, সেদিন দুপুরেই আমাদের বাড়িতে ডিম রান্না হয়েছে। খেতে বসে আশ্চর্য্য হয়ে দেখি, মা গোটা ডিমই ওমন অর্ধেক করে রান্না করেছে! মাকে জিজ্ঞেস করতে বলল-'  এ বাড়িতে যখন বিয়ে হয়ে আসি, তখন তো অনেক লোক এ পরিবারে। গোটা ডিম কারও জুটত না। সুতো দিয়ে কেটে ভাগ করে রান্না করতাম। এসব তোর জন্মের অনেক আগে। তুই এসব জানবি কী করে! আর, এমন ভাবে ডিম রান্না করলে, ডিমের ঝোলের স্বাদ-গন্ধও দারুণ হয়"।
মায়ের কথা শুনতে শুনতে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, মধ্যবিত্ত সংসারের রীতি গুলো স্থান ভেদে একটুও বদলায় না! সামর্থ্য সীমিত থাক, উৎস সীমিত হোক ক্ষতি নেই। বরং এর মধ্যেই - সর্বস্ব ভোগ নয় কিছু ত্যাগ, সম বন্টন- এই অন্যন্য জীবন বোধের উদযাপনও তো আছে মধ্যবিত্তের জীবনে!!
সুপ্রকাশ প্রকাশনা কে অনেক ধন্যবাদ, এমন একটি বই তাঁরা বই প্রকাশ করেছেন।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।