অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

এই বাড়িটি ছিল শহরের এক নাম করা উকিল গোপীকান্ত তালুকদারের। এখানে সপরিবারে আসার আগেই সতীশচন্দ্র রাখাই-কোম্পানির মাড়োয়াড়ি মালিকের সঙ্গে দেখা করতে আসার সুবাদে স্থানীয় কোর্টের বারে মোক্তার হিসেবে নাম লেখাতে গিয়েছিলেন, তখনই গোপীকান্ত উকিলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সতীশচন্দ্র বাড়ি ভাড়া খুঁজছেন শুনে গোপীকান্ত নিজের বাড়িতেই তাকে সামান্য ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

নাম লেখালেও, তখন তখনই সতীশচন্দ্র মোক্তারি প্র্যাকটিস শুরু করতে পারেনি। সে উপায় তাঁর ছিল না। মোক্তারি জমতে সময় লাগে, এই শহরে নামকরা উকিল-মোক্তারের অভাব নেই, নতুন কারও পক্ষে চট করে দাঁত ফোটানো মুশকিল। গোপীকান্ত উকিলের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সতীশচন্দ্র সাহস পাননি। প্র্যাকটিস জমতে জমতে খাবেন কী!

যতই সস্তার দিন হোক, পঞ্চাশ টাকায় দুই মেয়ে নিয়ে সেদিনও সংসার চলা কঠিন ছিল, তাই দিনের বেলা মাড়োয়াড়ি কোম্পানিতে রাখাই মালের 'আয়াত নির্যাত'-এর হিসেব রাখার কাজ, রাত্রে স্থানীয় একটি প্রেসে প্রুফ দেখা। দিনরাত খাটতেন সতীশচন্দ্র। আর প্রায় সারারাত আইনের বই পড়া, নোট করা, মোক্তারির প্রস্তুতি নেওয়া। এমন পয়সা ছিল না যে, ঐ পঞ্চাশ টাকার চাকরি ছেড়ে নিজে প্র্যাকটিশ করবেন।

বর্ধমানে রাজসরকারের প্রধান আমলার মেয়ে, জমিদারি-হারানো চৌধুরী পরিবারের বউ তরুবালা অভাব অভিযোগ নিয়ে স্বামীর কাছে কখনও অনুযোগ করেননি। বরং রাস্তাঘাট ধীরে ধীরে চিনে নিয়েছেন, দোকান-পাট। সংসারের উনের কুটি চুনের পান থেকে রেহাই দিয়েছেন সতীশচন্দ্রকে। তাঁর ভাষায় : সে ছিল তরুবালার সামন্ততান্ত্রিক স্বভাব থেকে এক ধরনের উত্তরণ।

মোক্তারি কাজটা সতীশচন্দ্রের পক্ষে সহজ হয়নি। ভারতীয় আইনের সবচেয়ে জটিল দিক হলো ভূমি-সংক্রান্ত আইন। সেই আইনের প্যাঁচ পয়জার বহন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। জমিদারির তত্ত্বাবধান করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি বনাম আসমানদারির দ্বন্দ্বে যে দশা হয়েছিল, অনেকটা সেই রকম। গোপীকান্ত উকিল প্রবীণ ও বিচক্ষণ মানুষ, তিনি সতীশচন্দ্রকে দেওয়ানি কোর্টে প্র্যাকটিশ করার পরামর্শ দিয়ে নিজেই তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে এলেন। তিনি জানতেন সতীশচন্দ্রের মতো মানুষের মোটেও ফৌজদারি প্র্যাকটিস সইবে না। সতীশচন্দ্র নিজে যৌথ পরিবারে থাকতে পারিবারিক জমি-জমা-সম্পত্তির হিসেব না রাখলেও গোপীকান্তের পরামর্শে এখানে মোটামুটি সফল হলেন।

প্রথমেই সতীশচন্দ্র নিজের চারপাশে একটি লক্ষ্মণরেখা কেটে নিলেন। মক্কেলরা তাঁকে আপনার লোক বলে চিনতে পারল। কোর্টে মাসখানেক যাতায়াত করার পরই সতীশচন্দ্র ঠিক করেছিলেন যে, তিনি অন্যান্য অনেকের মতো পরনিন্দা-পরচর্চা ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা-কুৎসায় অংশগ্রহণ করবেন না। বিগত তিন দশকে সতীশচন্দ্র বারের অনেক বিরোধ-বিতর্কের সাক্ষী এবং অন্য ধরনের মানুষ বলে একইসঙ্গে সম্ভ্রমসূচক দূরত্বের প্রাপক ও কুৎসামূলক আক্রমণের শিকার!

এই মন্ত্রকে সতীশচন্দ্র সাধনার মতো করে পালন করেছেন চিরকাল। রসে বশে থাকা নরেন মুহুরিই একমাত্র একঝাঁক উকিলের মাঝখানে দাঁড়িয়েও বুক চাপড়ে চিৎকার করে বলতে পারে— 'আমার মুক্তারবাবুকে নিয়ে কুনো কতা কইবে না। উনি কালো কোট-পরা সাধু, উনি 'গিরিহি' মহাপুরুষ।’

বছর কয়েক কাটার পর যখন বন্ধু ফণীভূষণের ব্যবস্থাপনায় বড়ো রাস্তায় ঘর ভাড়া নিয়ে সতীশচন্দ্র নিজের মোক্তারখানা খুললেন তখন তরুবালা সংসারের হাঁ থেকে তিল তিল করে বাঁচানো হাজারখানেক টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ততদিনে তাঁদের বড়োপুত্র নবীনের জন্ম হয়েছে। টিপু আর পিপু স্কুলে যেতে শুরু করেছে। শোভন হয়েছে প্রায় সাত-আট বচ্ছর তফাতে। সেই তরুবালা, অধিকারের আগ্নেয় কুণ্ড থেকে শ্রম-ইচ্ছা-মমতা-ভালোবাসা সংযমের সংঘাতে উঠে আসা তরুবালা, আজ নিজের কনিষ্ঠ সন্তানের অভিমানী কৈশোরকে শুশ্রূষা না করে তাকে অগ্নিকূপে নিক্ষেপ করতে উদ্যত! 

মানুষ এরকমই হয়।


অনন্যবর্তী
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।