শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯
কার্তিক মাসের শুরুতেই এদিকে বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে, সন্ধ্যা এসেছে অনেকক্ষণ, চারপাশ থমথমে, প্রায় জনশূন্যও বলা চলে। বাংলোর পেছনে চির-পাইনের বনে কুয়াশা আর উত্তরপথগামী বাতাস পরস্পরের সঙ্গে নিচু স্বরে প্রেমালাপে মগ্ন, ঝিঁঝি পোকার দল ডেকেই চলেছে একটানা, বিরতিহীন, অল্পক্ষণ বসে থাকলে মনে হয়, জগতে নিরবধি ঝিল্লিরব আর গহিন বাঘ-বনের মাঝে ইংরাজ আমলের শতাব্দী প্রাচীন এই বনবাংলো ব্যতীত অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব নাই। দূরে সাতপুরা পর্বতমালার পূর্ববাহী মৈকাল পর্বত, দিগন্তবিথারি ঘাস জমি, আদিবাসী জনপদ, প্রাণচঞ্চল অরণ্যভূমি সবই যেন কারোর ইশারায় চরাচর থেকে মুছে গেছে। এর আগে সুধীরবাবুর সঙ্গে পালামৌ গেছি, এমন কার্তিক মাসেই, কিন্তু সেখানকার অরণ্যে আজকের মতন দমবন্ধ তো হয়ে আসেনি। বারবার যেন মনে হচ্ছে, জঙ্গলের এই অংশে মানুষের প্রবেশাধিকার নাই, বনদেবী তাঁর হৃদয়ের গোপন দুয়ারের চৌকাঠ অতিক্রম করার অনুমতি কাউকে দেন নাই, তাই হয়তো গাঢ় সন্ধ্যার অবকাশে অরণ্যভুবন এমন নিঃসঙ্গ, শ্বাসরোধী হয়ে উঠেছে।
সহসা আমার চিন্তাজাল ছিন্ন করে থেমে গেল ঝিল্লিরব, কোথাও কোনো শব্দ নাই, নৈঃশব্দের সৌন্দর্যও মুছে গেছে, নীরবতার অধিক সর্বগ্রাসী কোনো মৌন-সম্মোহন সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে উঠে যেন আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে, যদিও কয়েক মুহূর্তেই ভেঙে গেল সেই সম্মোহন, একটি কোটরা হরিণের ব্বাক-ব্বাক আর্ত চিৎকার প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিয়েই পরক্ষণেই চুপ করে গেল, এক মুহূর্ত পর আবার শুনলাম সেই ডাক, এমনভাবে অল্পক্ষণ চলার পরেই বনভূমির সমস্ত মায়া-গহিন নীরবতা ভেঙে বেজে উঠল বনের রাজা, কী গম্ভীর, কী রাজকীয়, তার আভিজাত্যে এক মুহূর্তের জন্য বুকের রক্ত চলকে ওঠে, হাত-পা অসাড় হয়ে যায়, জঙ্গলের পশ্চিম দিক থেকে ভেসে আসছে সেই বজ্রকণ্ঠ, প্রথমে দু'বার, তারপর আরেকটু দূর থেকে আরও দুবার, সন্ধ্যালগ্নেই শিকারে বেরোল বাঘ, আমিও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম কান্হা অভয়ারণ্যের কোর এরিয়া এই সুপখার কোনো সাধারণ স্থান নয়।
বাঘের ডাক মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় রাখা একটি মেহগনি কাঠের আরাম কেদারায় বসে সুধীরবাবু আমার দিকে চেয়ে হাসলেন, 'জঙ্গলে পা দিতে না-দিতেই বাঘের ডাক! তোমার টাইগার-লাকের তো জবাব নাই হে!'
বারান্দাটি এত বড়ো যে কখনো মনে হয়, হরিৎ-সাগরের মাঝে কোনো জাহাজের ডেকে বসে আছি। শুধু বারান্দা নয়, বাংলোটি নিজেও অপরূপ। আসার পথে সুধীরবাবুর মুখে শুনেছি, এমন বনবাংলো নাকি ভারতবর্ষে আর একটিও নাই। প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা খড়ের চাল মিশর দেশের পিরামিডের মতন নেমে এসেছে, খড়ের নিচে মোটা ঘাসের আস্তরণ, শক্তপোক্ত শাল কাঠের অনেকগুলি থাম ছাদটিকে ধরে রয়েছে। পুরাতন দিনের চুন-সুরকির গাঁথনির বিশালাকায় চারখানি ঘর আর এই টানা বারান্দা দেখেই বোঝা যায় ইংরাজ আমলে তৈরি এই বাংলো অবিকল সংরক্ষণ করে রাখা আছে। খড়ের চাল আর চুন-সুড়কির দেয়ালের জন্য মধ্যভারতের অসহনীয় গ্রীষ্মে এই বাংলো অতি-আরামপ্রদ, আবার হাড়-কাঁপানো শীতেও নিভুনিভু আখার আঁচের উষ্ণতা টের পাওয়া যায়।
আসবাবপত্রও স্মৃতিকাতর, ল্যাজারাসের ইংলিশ খাট, মেহগনি কাঠের আরামকেদারা, সোফা, বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নার চারপাশে রুপোর কারুকাজ, বিশাল বিশাল খড়খড়ি জানলার উপরে খসখসের ভারী আস্তরণ, কলঘরে বাথটাব, এমনকি প্রতিঘরে হাতে টানা পাখা অবধি রয়েছে, সেকালে পাঙ্খা-পুলার ছিল, এখন পাখাগুলি উঁচু ছাদ থেকে অতীতের পানে নিথর তাকিয়ে থাকে।
আসছে শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯
শ্বাপদ রাত্রি
সায়ন্তন ঠাকুর
অলংকরণঃ ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
#সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment