শৈব্যা কথন। জয়া মিত্র।

"জ্ঞান হওয়া অবধি শৈব্যা শুনে এসেছে, মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক দৈবনির্দিষ্ট। এজন্য সন্তানের জন্ম দিয়ে মাতৃমর্যাদা লাভই স্ত্রীলোকের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন এবং পুত্রের জননীই সংসারে সমাজে সাক্ষাৎ দেবীস্বরূপা। সে মুহূর্তে মাতা ও সন্তানের মধ্যকার সেই দৈবনির্দিষ্ট অচ্ছেদনীয় সম্পর্কের কথা মিথ্যা প্রমাণ হল। কেবল অর্থশালী ক্রেতাটির কৃপাই শৈব্যাকে তার আপন শরীরসঞ্জাত সন্তানের নৈকট্য ভিক্ষা দিতে পারে। সেই সদ্যপ্রভু ক্রেতা অত্যন্ত পরুষভাবে উত্তর দিল— তুমি বরাঙ্গী, তদুপরি রাজমহিষী ছিলে, এ কারণেই চতুঃসহস্র স্বর্ণমুদ্রা তোমার জন্য ব্যয় করেছি। এর এক-চতুর্থাংশ মূল্যে কুশলা দাসী ক্রয় করা যায়। তার ওপর তোমার পুত্র ? অসম্ভব। এ আমার কোন কাজে লাগবে।

আমি পরে শুনেছি সেদিন সেই প্রাঙ্গণে বহু জ্ঞানবৃদ্ধ, বহু শাস্ত্রজ্ঞ এমনকী কোনো কোনো মুনিও উপস্থিত ছিলেন। এই সমস্ত কিছু তাদের সকলের সামনেই সংঘটিত হচ্ছিল। যখন ভর্তা তাঁর পত্নীকে অর্থমূল্যে বিক্রয় করেছিলেন, যখন ধনবান বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি শিশুটির অপ্রয়োজনীয়তার কথা বলে মাকে ক্রয় করে নিজ আলয়ে যাচ্ছিল, যখন সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেছিল যে অযোধ্যার মহিষীকে ক্রয় করছে— কেবল এই আত্মতৃপ্তির কারণেই সে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য দিয়েছে এবং ক্ষণপূর্বে যে অতি সম্মানিত ছিল, সেই নারী এক্ষণে সাশ্রুনয়নে শিশুটিকে বুকে ধরে পথের ধুলার মাঝখানে নতজানু বসে আপন সন্তানকে কাছে রাখবার জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছিল— এই সব কিছু সেই শিশুর জন্মদাতা, সেই জ্ঞানী ও ক্ষমতাশালী নাগরিকেরা, শাস্ত্রজ্ঞ ও ভগবদবিদ মুনিগণ সকলেরই সামনে ঘটছিল। কোথাও থেকে একটি নিশ্বাসও প্রতিবাদ করেনি। ফলত সেই ব্রাহ্মণ পুনরায় বলে— ওঠো ওঠো, এই দ্বিপ্রাহরিক রোদে আর আমি কালক্ষেপ করতে পারি না। শীঘ্র চল—

আর শক্তিমতী হয়ে ওঠা শৈব্যা, সেই পণ্যরূপিণী শৈব্যা, তার জীবনে প্রথমবার কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল— প্রভু, এর জন্য আপনাকে কোনো মূল্য দিতে হবে না। কোনো খাদ্যদ্রব্যও দিতে হবে না, আপনি আমাকে যে তণ্ডুল দেবেন তাই আমি আমার পুত্রকে খাওয়াব। কিন্তু আমি এর জননী, আপন শিশুকে পরিত্যাগ করে আমাকে যেতে বলবেন না। আমি আত্মঘাতিনী হব, স্ত্রীহত্যার পাতক আপনাকে স্পর্শ করবে।

এরপর ব্রাহ্মণ রোহিতাশ্বকে তার জননীর কোলে উঠতে দেয়। কিন্তু শৈব্যার স্পর্ধাবাক্য সে বিস্মৃত হয়নি। 'আমার অংশের তণ্ডুলই আমি রোহিতাশ্বকে খাওয়াব।'—এই কথার প্রতিফল হিসাবে পরবর্তী তিনটি বছর ধরে প্রতিদিন নিজহাতে তণ্ডুল মেপে শৈব্যাকে সেই বিপ্র, পদ্মমাধব, একটি মানুষের ন্যূনতম পরিমাণ প্রয়োজনীয় খাদ্যের চেয়ে কম তণ্ডুল দিয়েছে। দিনে দিনে রোহিতাশ্ব বড়ো হয়েছে, আমি নিজের খাদ্যের তিন চতুর্থাংশ তার মুখে তুলে দিয়েছি। তবু কী দুর্বল, ক্ষীণস্বাস্থ্য ওই ছেলে, দেখে আমার প্রাণ কেঁদে উঠেছে।"




শৈব্যা কথন
জয়া মিত্র

প্রচ্ছদ: মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য: ১৬০ টাকা
#সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।