আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর। পাঠ প্রতিক্রিয়া।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের  বই ' আহাম্মকের খুদকুড়ো ' পড়ে লিখেছিলেন এনাক্ষী মুন গোস্বামী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
...............................................
'যা হারিয়ে গেছে তা আগলে বসে রইব কত আর...'

স্মৃতিগদ‍্য পড়ছি, বেশ কিছুদিন। ভিন্ন ভিন্ন সময়, তাদের বিভিন্ন রূপ-রঙ-বর্ণ-গন্ধ-স্বাদ। সে বর্ণণ এক-একজনের কলমে এক-এক কলেবর পায়। বেড়ে ওঠে। বুড়ো হয়ে, হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া যেখানে, ঠিক সেখানেই একলা বাঁশির সুরে ভেসে আসে মেলানকলিয়া। অন্ধকারের সিল‍্যুয়েট জাদুগরিতে ভেসে ওঠে এক একলা কিশোর, যুবক কিম্বা আহাম্মকদের গল্প। যার সাক্ষী থাকে হারিয়ে যাওয়া এক জোছনা রাত, আর নির্জন নদীপাড়। 

কথা হচ্ছে দুর্লভ সূত্রধরের 'আহাম্মকের খুদকুড়ো' নিয়ে। একজন বালক, সেখান থেকে কৈশোর হয়ে, আহাম্মকত্বের চূড়ান্তে পৌঁছে যাওয়ার সফরনামা। আহাম্মক কারা প্রসঙ্গে লেখক নিজেই বলেছেন গুস্তাভ্ ফ্লবেয়ারের উদ্ধৃতি কোট করে: "দোজ হু ডিফার উইদ ইউ" দোজ আর ইডিয়টস। আমি আপনি আমরা সবাই কোথাও না কোথাও গিয়ে ইডিয়ট। 
স্মৃতির সঙ্গে সর্বক্ষণ ভারাতুর জুড়ে যারা নিজেদের ফেলে আসা দিনকে গোল্ডেনের তকমা লাগিয়ে দেয় তারা আহাম্মকের দলে পড়েনা। বরং শেয়ালে কামড়ানো, 'কুলে খাওয়া'রাই আহাম্মক। যারা স্থান-কাল-পাত্র ভুলে হঠাৎ গেয়ে উঠতে পারে, 'না হয় তোমার যা হয়েছে তাই হল, আরো কিছু নাই হলো' কিম্বা 'জিন্দগি ক‍্যায়সি হ‍্যায় পহেলি হায়...'  ইন ট্রু সেন্স তারাই আহাম্মক। কারণ তারা বাঁচে এক রূপকথা জীবন। খাপরার টুকরো ভরা আঁচল তাদের। সরস্বতী পুজোর হেল্পার, কিম্বা এখোগুড় রুটিতে তাদের হীনযন‍্যতা নেই, আবার এসব হারিয়ে যাবার পরেও তীব্র হাহাকার নেই। বরং গ্রীষ্মরাতের ঝরে পড়া বকুল ফুলের মত এক মৃদু সুঘ্রাণ লেগে রয়েছে মনে। কোনো লাইফস্টাইল কোচ এদের শেখাননা, 'টেক লাইফ অ্যাজ ইট ইজ' বরং ফেলে আসা সোনালীদিন সাথে নিয়েই তারা পাড়ি দেয় আগামীতে। 

স্মৃতিগদ‍্য যেমনটা হয়, খুব মনখারাপি, হাহাকারে ভরা আহাম্মকের খুদকুড়ো ঠিক তার বিপরীতবাসী এক গ্রন্থ। প্রসঙ্গক্রমেই এখানে এসেছেন সংসারী গিন্নীরা, লেখক তাদের সম্বোধন করেছেন 'অন্নপূর্ণা মা আর দয়াবতী দিদি'। মধ‍্যবিত্তের হাঁড়ি-হেঁশেল সামলাতেন তাঁরা কোনরকম প্রফেশনাল ট্রেনিং ছাড়াই। রোজের শাকওয়ালি থেকে কালেভদ্রের কাসুন্দিওয়ালা তাঁদের মমতায় সিঞ্জিত হতেন সকলেই, কিন্তু সেখানে দয়া করুণার কোন স্থান নেই। কারো জন‍্য বাড়তি কিছু নেই, আবার কেউ কাঙাল হয়েও চলে যায়না। বাড়ির অসুস্থ সদস‍্যের পথ‍্যের দিন তাই ঘি দিয়ে রাঁধা পোড়ের ভাত অল্প করে হলেও পায় বাড়ির সকল খুদেরাই। আবার সবার অলক্ষ‍্যে অর্ধেক ডিমের স্থির হিসেব ছাপিয়ে বিশেষ কৃতীসন্তান পায় মায়ের থেকে ভাগ। 

এতো গেল বাড়ির কথা। বাড়ির বাইরে বিশ্বশিক্ষার শুরু হয় যেখানে সেই ইস্কুলের নাম রিপাবলিক। যেখানকার রক্ষণাবেক্ষণে হেডস‍্যার, গোপেনবাবু, ভূপেশবাবু সুধন‍্যবাবুদের মত আর্কণ বা স‍্যারেরা। ছেলেদের সঙ্গে যাদের শুধু সখ‍্যই নয় পরস্পরের মধ‍্যে ছিল সম্মানের এক আশ্চর্য নিগড়। তাতে কখনও ভাটা পড়েনি। বরং যুদ্ধের বাজারে সে সম্পর্ক হয়েছে আরও সুদৃঢ়। "সেই কারণেই বিপন্ন সাধারণ মানুষেরা নিরাপত্তার সন্ধানে আমাদের দেশে এসেছেন। তাঁরা আমাদের অতিথি।" হেডস‍্যারের এই বারতাটুকু আহাম্মকদের উদ্বুদ্ধ করে। তারা এগিয়ে যায়, জীবনে। 

বাঁচা কাকে বলে? সে কি শুধু অতীত আঁকড়ে, নাকি বর্তমানের প্রাচুর্যের অহংয়ে নাকি এসব ছাড়াও আরও অন‍্যভাবে? সরস ভঙ্গিতে এই বইয়ের প্রতিটি অধ‍্যায়ে লেখক তা বর্ণণা করেছেন। পড়তে পড়তে চোখ ছলছল করেনা, মন-কেমন করেনা, মনেই হয়না কিচ্ছুটি হারিয়েছে। বরং আমরা চলছি তারাও চলছে আমাদের সঙ্গেই এই জাতীয় শান্তি বা নির্লিপ্তি ছড়িয়ে রয়েছে বইটিতে। এই বই যা আমাদের প্রতি লাইনে মনে করায়, ডুমাটোলার দাদু আর হৃষিকেশ মুখার্জীর হিরো সবাই একই বারতা দিতে চান: 'বাবুমশাই জিন্দগি বড়ি হোনি চাহিয়ে,লম্বি নেহি।' প্রতিটি অধ‍্যায়ের অদ্ভুত এক নামকরণ--- পিতলের নাগরা জুতো, রিপাবলিকের সম্মানীয় দাসেরা, ইলনারতত্ত্ব ইত্যাদি। নাম দেখে কিছুমাত্র আন্দাজ করা যায়না, বিষয়বস্তু কী? যেন এক নীল রঙের ইনল‍্যান্ড লেটারখাম। গোপনীয়তা ভরা এক লেফাফা। সৌজন‍্য চক্রবর্তীর প্রচ্ছদ নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই, শুধু দুর্লভ সূত্রধরের অলংকরণ মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। সাদা-কালোয় অনবদ‍্য সে গ্রাফিক্স। 

আমরা যারা স্মৃতিবিলাসী, ছিন্নমূল কিম্বা মেলানকলিক--- এক কথায় আমাদের মত আহাম্মকদের জন‍্য এ বই এক অনবদ‍্য উপহার।

(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: খুব ছোটবেলায় রেফারেন্স বইকে ভয় পেতাম। একে পাঠ‍্যবই, তারপর সেই একই বিষয় নিয়ে আরো বিস্তৃত আলোচনা বিরক্তির উদ্রেক করত। বড় হয়ে জেনেছি কোন বিষয় বুঝতে গেলে, তাতে ধারণ করতে গেলে টীকার সবিশেষ প্রয়োজন। এই বই নিয়ে পাঁচটি পর্যায়ে এক দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন শ্রীঅর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। যা আমাকে এই বইটিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায‍্য করেছে। তাঁকে সবিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।)

আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর
সুপ্রকাশ প্রকাশনা 
মুদ্রিত মূল‍্য: ২৮০₹

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।