শঙ্কর মাস্টার।। বরুণদেব।।

বাস থেকে নেমে মাটির রাস্তা ধরে ধানের জমির সাথে আলাপ করতে করতে, গরুর গাড়ির পিছনের বাঁশ ধরে ঝুলে ঝুলে ধুলো খেতে খেতে, কানফলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যেতে যেতে, 'নপা এলি? জামাই এলো না ক্যানে? নপা কেমন আছিস? ব্যাটাবিটি বড় হয়ে গ্যালো তো', এসব কুশল বিনিময়ে ঠোক্কর খেতে খেতে, আমাদের মা নপা অর্থাৎ নূপুরের হাত ধরে আমরা, দিদি আর ভাই, বুড়ি পুকুরের জলে পা ধুয়ে এক ছুট্টে মামার বাড়ি। আমার সেই 'নো ছাপছুপ, নট কিচ্ছু, ঠকাস ঠাঁই' মার্বেল-গুলি খেলার বয়সে বা দিদির 'আতা আতা আতা, দুধ-কলমির পাতা'-র কার্তিকেয় প্রদীপ জ্বালানোর সময়ে, মামাবাড়ির গ্রামের 'কানফলা' নামটি নিয়ে আমাদের সঙ্গীসাথীদের টিপ্পনি কম ছিল না, এমন নাম হলে রঙ্গব্যঙ্গ তো হবেই! আমাদের গঞ্জ টাইপের মাটিয়ারির সাথে এই ছোট্ট গাঁ কানফলার আসমান জমিন তফাৎ। কৃষিপ্রধান ছোট্ট গাঁ। আমার দিদিমার কথায়—ধানপানের দ্যাশ। ধান দিয়ে যায় চেনা। দ্যাড় ফ্যার, এক ফ্যারের বেচাকেনা। অর্থাৎ দেড় বা এক পাল্লা ধানের বিনিময়ে শাকসব্জি ফলমূল। সপ্তাহে দু'একদিন আসা ফেরিওয়ালার সাইকেলে শক্ত করে বাঁধা এক ধামা। দু আনা চার আনা ষোলো আনার ঠং করার বদলে ধান দিয়ে জিনিস কেনাই রীতি। চাষির বাড়িতে ধানের গোলা। ভাঁড়ারের বস্তায়, মাটির জালায়, অ্যালুমিনিয়ামের ক্যানে, সমবচ্ছরের ভাত মুড়ি গুড়ের রসদ। ভাত-মুড়ি-ভাতে চারবেলার উদরপূর্তি। এ বাড়ির গোয়ালের গরুর দুধের খবর রাখে ও বাড়ির গোয়াল। একদশীতে বিধবাদের রুটি গুড়ের ভাগে কচিকাচাদের আনন্দ। চিনির থেকে গুড় বেশি আদরের। শীতকালে খেজুরের গুড়, সারা বছর জমির আঁখের গুড়। জামাইরা অতিথিরা এলে লুচি রুটি পরোটার গন্ধে ভোজ।

এই গাঁয়ের সম্ভ্রান্ত চট্টরাজ পরিবারের বড় মেয়ে নপার সাথে শঙ্কর মাস্টারের প্রজাপতয়ে নমঃ। ছেলেটা মাস্টারি করে, ভালো ছেলে, নেশা ভাঙ করে না, বাড়িতে রাধাগোবিন্দ, মা গঙ্গার পাড়ের দেশ, বর্ধিষ্ণু গ্রাম, ঘরে ঘরে পেতল। কাজে কাজেই এক বর্ষার সন্ধ্যায়, গরুর গাড়ি করে, টোপর মাথায় শঙ্কর মাস্টার ও বরযাত্রীর দল হ্যাজাকের আলোয় চট্টরাজ বাড়ির 'যদিদং হৃদয়ং তব'-র 'শুভবিবাহ সম্পন্ন হইল'-র মাঙ্গলিক মণ্ডপে হাজির হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাবা সিদ্ধেশ্বর চট্টরাজকে হারায় নপা। বাবার দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলে, পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই, ছোট্ট ঝন্টুর নপার আঁচল জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি—বড়দি, আমাকে ছেড়ে কোথায় যাচ্ছিস? আমাকে নিয়ে চল। কোলে তুলে নেয় শঙ্করমাস্টার—চল আমাদের সঙ্গে, দু মুঠো ভাত ঠিক জুটে যাবে। ছোট্ট ঝন্টুর জীবনের পরবর্তী এক দশক দিদি-জামাইবাবুর অভাবী যৌথ পরিবারে যায় কেটে।

আর আমের রস গড়িয়ে পড়া হাত চাঁটতে চাঁটতে বা প্রভাতী খেজুর রসের কনকনানিতে, আমার শৈশব কৈশোরের গ্রীষ্ম-শীতের অবকাশ কেটে যায় মামার বাড়ির আদরে। ব্যাঙের বিয়ের হুল্লোড়ে, সন্ধের হ্যারিকেন-চণ্ডীমণ্ডপে কথকতার আসরে, ছোটদত্ত, বড়দত্ত, বুড়ি পুকুরের জলে কাগজ নৌকায়, গরুর গাড়ির চাকার ধুলোয়, রাখাল মাহিন্দারদের সাথে ধানের জমিতে আঁখের ভুঁইয়ে, আমার গ্রীষ্ম-শীতের আহ্নিকগতি বার্ষিকগতি। এ বাড়ির চাষবাসের কাজে, জমিতে লাঙল দেওয়া থেকে গোলায় ধান ওঠানো, শেষ কথা পুণ্যামামা। পুণ্যামামার বাড়িতে তার ভাই সহদেব কুলদেবদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসে সানকিতে পান্তা ভাতের আমানি খাই। রাখাল মাহিন্দারদের গরু চরানো বেলায়, বাছুরের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে আমিও সহদেব কুলদেবদের সঙ্গে 'মায়ের পায়ে জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন' শ্যামাসংগীতের সুর রাখালিয়া গানে বসাই— 'এ বাছুর লণ্ডনে যাবে, এ শালো সাহেব হবে, বিয়ান বেলায় খ্যারের (খরের) গাদায় ফিরবে কি তখন'। মামাবাড়িতে মামা-মাসিদের আলমারি ঘাঁটি আমি। সেখানে বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকার পাশে মেয়েদের ব্রতকথা, লক্ষ্মীর পাঁচালির পাশে দুটো সোজা একটা উল্টো উলবোনার নকশা, গীতবিতানের পাশে দেবদাস, শিব্রাম চক্কোত্তির পাশে বড়দের চোখ পাকানো ধনরাজ তামাং-এর উল্টোরথ। পাতা ওলটাই। বারবার পড়ি, বুঝি বা বুঝি না, বারবার পড়ি। আর থাকে যাত্রার বই।


শঙ্কর মাস্টার 
বরুণদেব 

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত 

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।