ছায়ার পাখি।। অভিজিৎ সেন।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত অভিজিৎ সেনের উপন্যাস 'ছায়ার পাখি' পড়ে লিখেছেন মণিপদ্ম দত্ত। আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। বইটির প্রচ্ছদশিল্পী : সৌজন্য চক্রবর্তী।
...................................................................................................
অভিজিৎ সেনের মহাকাব্য ছায়ার পাখি
..........
ছায়ার পাখি মূলত একটি পাখিরই আখ্যান। এক অসহায়া সহজ স্বপ্নবিলাসী  মেয়েকে ঘিরে গড়ে ওঠা এক সময়ের উপাখ্যান। পুরনো স্বপ্নের মৃত্যু ও ক্রমবিবর্তন ঐ পাখিটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় এক জানা গল্প যার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে অনাবিষ্কৃত মনুষ্যত্বের খণ্ড খণ্ড চিত্র। ঐ গর্ভবতী পাখিটিকে অনন্ত যত্নে প্রতিপালনের জন্যেই যেন সমস্ত চরিত্রের সৃষ্টি। সে যে জন্ম দেবে নতুন প্রাণের। তার প্রতারক প্রেমিক এক আধুনিক ক্ষমতা বিস্তারি রাজনৈতিক  লুম্পেন । তাই  সকলের পক্ষ ছায়ায় রাজেশ্বরীর আশ্রয়। খানিকটা  সে কারণেই যেন লেখক এ কাহিনীর নামকরণ করেন ছায়ার পাখি। সে তো জন্ম দেবে আর একটি পক্ষী শাবকের। এবং তাই তাকেও ছায়া হয়ে উঠতে হবে, ছায়া দিতে হবে। 
অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে আমাদের জানা একটি চরিত্র পাই। গোপাল মজুমদার। অনেকটা কেন্দ্রীয় চরিত্রও বটে। যে মানুষটি একটি আদ্যপান্ত নাগরিক জীবন জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু  আদর্শ বোধের মমত্বে, টানে নয়, তার ষাটোর্ধ জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে এক গ্রাম্য পরিবেশে। তাদের একজন হয়ে। বহু সহকর্মীর মতো সে সমাজের শ্যাওলা হয়ে যায় না। ঋজু আবেগে প্রান্তিক মানুষগুলর জন্যে কাজ করে যায়। এই অদ্ভুত নির্মোহটাই তার মোহ । গোপালের স্মৃতি আছে।  আক্ষেপ নেই। বাম রাজনীতি নয়, কমুনিষ্ট মূল্যবোধ তাকে শিখিয়েছে, সাধারণ হয়ে ওঠাটাও জীবনের পরম লক্ষ্য হয়ে উঠতে পারে। অভিজিৎ- এর রাজনৈতিক দর্শনই বোধ হয় গোপালে প্রোথিত।  
আরও একটি অলীক মানুষ সাগরের চরিত্রটি যা এই আখ্যানের দাঁড় বয়ে যায়। তার অলৌকিক গান, উধাও প্রান্তরে পদচারণা, রাজেশ্বরীর প্রতি গহন-গোপন প্রেম, সজাগ রক্ষা-কর্তব্য এমন এক প্রান্তিক মানুষের কথা বলে, যা গোপাল মজুমদারের বিপরীতে একই রকম বিরল মানবিকতার ভাষ্য তৈরি করে। গোপালের চরিত্রের পরিপুরক হয়ে সাগর আমাদের সত্তায় স্থান করে নেয়। এরকম আরও চরিত্র আছে যারা জীবন্ত তবু আমাদের অগোচর। আমাদের সমাজবদলের আন্দোলনে এই মানুষেরা সাহিত্যের পাতা থেকে বাস্তবে উঠে আসাটা বড় দরকার। ছায়ার পাখিতে এই সত্য পুনঃ প্রতিষ্ঠা পায়।
বইটি পড়তে পড়তে অদ্ভুত আচ্ছন্নতার ভিতর ঢুকে পড়ি। মহাকাব্যিক। কেন জানি না রমেশ সেনের কুরপালার কথা মনে পড়ে যায়। বহুকাল আগে পড়েছি। এবং রমেশ সেন আমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে রয়েছেন সেই কবে থেকেই।
বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস অভিজিৎ সেন ছাড়া অসম্পূর্ণ।
চোখের সামনে বেনেবৌ পাখিটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে জামরুল গাছের সবুজ জঙ্গলে একটা নিঃশব্দ দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়, একটা নিঃশব্দ হুলুস্থুল। জামরুলের ঘন সবুজ পাতাগুলো সদ্য অতিক্রান্ত শরতের বৃষ্টিতে ধোয়া এবং উজ্জ্বল। গাছের তলায় পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে গড়িয়ে আসা রোদের আল্পনার রং এখনো বড় প্রাণবন্ত। ঘাস এখনও শিশির ভেজা। যেসব পতঙ্গ জ্যোতির্মুখি, তারা সকালের শিহরণ লাগা বাতাসে সাঁতার কাটে। আর তখনই পাখিটা কলকণ্ঠে ডেকে ওঠে। ডেকে ওঠা নয়, যেন হুলুধ্বনি জোকার দিয়ে ওঠে। সেই কলধ্বনি নিমেষে গোপালকে দুঃখী ও তাপক্লিষ্ট করে। কেননা, মানুষের স্মৃতিতে কত পরিতাপ থাকে, থাকে ঘৃণা, ক্রোধ, হতাশার অঙ্গার বা পিঙ্গল বিদ্বেষ।
এই নিটোল কবিতা, এবং এরকম অসংখ্য পঙক্তি(ছত্র নয়) আবিষ্ট করে রাখে আমাকে ছায়ার পাখিতে। আলাদা করে আর চম্পূ অন্বেষণ করতে হয় না।
এই ভালো লাগাগুলির জন্য বেঁচে থাকাটা প্রচণ্ড জরুরি বোধ হয়।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।