শঙ্কর মাস্টার।। বরুণদেব।।
দশমীর ভাসান-কোলাহল শেষ হলে, মধ্যরাতে বিষাদের সুর তুলে জেগে থাকে রুইদাসপাড়া। ছাদে মাদুর পেতে নীল আকাশে সাদা মেঘেদের ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে ঘুম আসে আমার চোখের পাতায়। ভোরের আলো ফুটলে দেখি, কখন শঙ্কর মাস্টার এসে গায়ে দিয়ে গেছে চাদর। ছাদের দরজা ভোরের বাতাসে দুলে ওঠে...
আমি স্পর্শ করি ছাদের দরজা। একটা একটা করে ইঁট গেঁথে বন্ধ করা হয়েছে সে দরজা। সমাধি এক। কান্না উঠে আসে কবরের নীচ থেকে।
ছেলের কবরের পাশে এসে দাঁড়ায় শঙ্কর মাস্টার। উদভ্রান্ত। কাঁধে চালের পুঁটুলি।
—রহমত, ঘুমিয়ে পড়েছিস? উঠে আয় বাবা।
কবরের পাশে বসে পড়ে শঙ্কর মাস্টার। চালের পুঁটুলি খুলে আঁজলা ভরা চাল নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কবরের দিকে ঝুঁকে পড়ে। গলা কাঁপে।
—এই দ্যাখ রহমত, চাল এনেছি। আয়, বাপ ব্যাটা মিলে ভাত রেঁধে খাব। তুই যে বলেছিলিস— আব্বু, বড় ক্ষিধে, ভাত দাও।
চালভর্তি হাত দুটো চোখের সামনে তুলে ধরতে ধরতে কবরের দিকে পিছন ফেরে, হাত থেকে চাল পড়ে যেতে থাকে...
—এ পৃথিবীতে ভাতের গন্ধ ভীষণ দামি রে রহমত! কেউ দেয় না। কেড়ে নিতে হয়।
এক পা এক পা করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় শঙ্কর মাস্টার......
—নায়েব মশাই এর পা দুটো জড়িয়ে ধরে কত করে বললাম—বাবু, ছেলেটার অসুখ। ঘরে দানাপানি নেই। দু মুঠো চাল দাও। মা-মরা ছেলেটার মুখে একটু ভাত তুলে দিই। আমি গতর দিয়ে খেটে সব শোধ করে দেব।
শঙ্কর মাস্টার সেন্টার স্টেজে চলে আসে...
—চাল দিলে না। বদলে দিলে চাবুক। শঙ্কর মাস্টার সামনের দিকে ঝুঁকে কুঁজো হতে হতে বলে ওঠে...
—জমিদারের পেয়াদা এসে চাবুকের পর চাবুক মেরে দেউড়ির বাইরে বের করে দিল।
উঠে দাঁড়ায় শঙ্কর মাস্টার। চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। চোখের পাতা নড়ে না। প্রতিশোধের চোখ। অস্থির পদক্ষেপে অবস্থান বদলে বদলে যায়...
—লুঠ করেছি। জেলে পাড়া, বাউরি পাড়া, হাড়িপাড়া জেগে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে লুঠ করেছি জমিদারের চালের গুদাম।
কবরের দিকে ফিরতে থাকে শঙ্কর মাস্টার...
—আয় রহমত, দারোগা আসার আগে আমাদের পালাতে হবে। অন্য কোনো গাঁয়ে। রহমত, শুনতে পাচ্ছিস?
কবরের ওপর ঝুঁকে পড়ে শঙ্কর মাস্টার...
—শুনতে পাচ্ছিস রহমত? র...হ... ম...ত...
হাহাকার করে ওঠে শঙ্কর মাস্টার। কবরকে পিছনে রেখে সেন্টার স্টেজে আসতে আসতে দু হাত তুলে বলে ওঠে শঙ্কর মাস্টার...
—হায় আল্লা, তোমার দরবারে দুমুঠো ভাতের অধিকার কেড়ে নেয় জমিদার! আর আমাদের রহমতরা খিদের জ্বালায় ঘুমিয়ে পড়ে কবরে।
বুক চাপড়াতে থাকে শঙ্কর মাস্টার। দু'চোখ দিয়ে জলের ধারা নামে। শঙ্কর মাস্টারের গ্লিসারিনের দরকার পড়ে না।
নামাজের ক্ষীণ সুর শোনা যায়। পুঁটলির চাল ঢেলে দেয় কবরে। বসে পড়ে নামাজ পড়তে। নামাজের সুর স্পষ্ট হয়....
সানাই এর সুর ফেরে দশমীর ঘট বিসর্জন করে। আমি, শঙ্কর মাস্টারের সমালোচক এক, যাত্রায় প্রবল অনীহা, মাথা রাখি ছাদের দরজায়। একটা একটা করে ইট দিয়ে গাঁথা সে দরজা। আমাদের গ্রীনরুম-সিংহাসন-মঞ্চ ছাদের দরজা। আমার বাইফোকাল চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে আসে...
শঙ্কর মাস্টার
বরুণদেব
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment