শঙ্কর মাস্টার।। বরুণদেব।।

মোমবাতির কাঁপা শিখায় খেয়াঘাটের একমাত্র চায়ের দোকানে আলো ছায়ার ত্রিকোণমিতি। আকাশে গুটিকয় তারা। চাঁদের ইশারা নিয়ে রাত্রি নিবিড় হয়। খণ্ডিত অন্ধকারে গাছেরা দোলায় মাথা। শেষ খেয়া পাড়ে ভিড়লে দিনের ক্লান্তি মুছে ফেলে আত্মমগ্ন হয় খেয়াঘাট। 'সেই হরিনাম তুমি গাইবে কবে'। ঘাটে নৌকা বেঁধে গান গাইতে গাইতে মাঝি উঠে এসে বসে চা-দোকানের বেঞ্চে। 'তুমি শঙ্কর মাস্টারের ছেলে না?' মাঝি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আমার দিকে। হাওয়া বয়। জনক জননী হাওয়া।

দোকানের বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ি আমি। ঘাটে এসে দাঁড়াই। হাওয়ারা বয়। সন্ন্যাসী গ্রীষ্ম, বৈরাগী বসন্ত, জলপরী বর্ষারা ঋতুচক্রের নাগরদোলায় নদীর পাড় ধরে বয়ে যায় জনপদে জনপদে। শিউলি ঝরা শরত শেষে মরচে রঙা কাশের সাথে আলাপনে বসে জনপদের বাতাস। জবুথবু শীতে দুয়ার আঁটে। ঋতুচক্র বয়ে চলে। বয়ে চলে নদী। জনপদ। সময়।

সময়ের কথা সময় জানে। আর জানে ভেসে যাওয়া খড়কুটোরা। কালের নিয়মে নশ্বর এ দেহ চিতার আগুন, কবরের মাটি হয়ে বিলীন হয়ে যেতে যেতে রেখে যায় তরঙ্গ কিছু, সময়ের হাত ধরে, সময়ের কাছে। বাতাসে রেণু রেণু স্মৃতি। সেই স্মৃতির সুবাস নিয়ে কণা থেকে কণায় ভাঙতে ভাঙতে, তরঙ্গের সাথে তরঙ্গ জুড়তে জুড়তে, খড়কুটোরা সময়ের বহতা স্রোতে ভেসে চলে, হারিয়ে যায়। পড়ে থাকে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি। ফসিল হয়ে যাওয়াই তার ভবিতব্য। কালেরই সে নিয়ম।

আমি আঁজলা ভরে তুলে নিই নদীর জল। জল থেকে উঠে আসে সাজাহান, দিলদার, হরিপদ, সিরাজরা। যাত্রার ঝলমলে পোশাকে আবছায়া নদীতটে দাঁড়িয়ে তারা কুর্ণিশ জানায় এ জনপদকে। কুর্ণিশ জানায় প্রবাহকে। সে প্রবাহ নানাধারায় বয়ে চলে। আমি, এ জনপদের গত শতাব্দীর সাত-আটের দশকের মুগ্ধ কিশোর এক, প্রবাহের পাড় ধরে চলি। এক কাঠের চেয়ারে বসে থাকে শঙ্কর মাস্টার, আমি প্রদক্ষিণ করি। চেয়ারের পা চারটি শিকড় হয়ে চারিয়ে যায় চতুর্দিকে। মূলরোমে মূলরোমে শিহরণ। কাঠের চেয়ার গাছ হয়ে ডালপালায় পাতায় পাতায় ছায়া দেয়, বাতাস দেয়, বৃষ্টিতে ভেজে। শঙ্কর মাস্টার আপনমনে হাসে, কাঁদে, ঝড় তোলে, বৃষ্টি নামায় সংলাপে সংলাপে। খোলা বারান্দায় শেষ বিকেলের আলো এসে পড়ে। শঙ্কর মাস্টার উচ্চারণ করে-
'এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছি মৃত্যুর দিকে। আর জীবনে সকাল নেই, দুপুর নেই, সন্ধেও ফুরিয়েছে। এখন শুধু মাঝরাত্তিরের অপেক্ষা। এরপরে রজনীবাবু বলবেন, ভাই, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আর লাস্ট সিনে প্লে করব না, কিন্তু কার্টেন উঠবেই। শ্মশানঘাট, পরিচিত বন্ধুবান্ধব, ওপারের দূত উইংসে রেডি...'

তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। খণ্ডিত হয়, বিখণ্ডিত হয়। আমি খণ্ডের সাথে বিখণ্ড জুড়ি। তখনই ক্ল্যারিনেট বেজে ওঠে। নট ও নটীরা যে যার খোলসে ঢুকে পড়ে। পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি মঞ্চকে আশ্রয় করে। স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল ঝড়, সামাজিক নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সমকালীন সময়, আছড়ে পড়ে কাঠের পাটাতনে। আয়তক্ষেত্র জুড়ে মায়াময় জ্যামিতি। ভাঙে, গড়ে, বদলায়, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর, প্রথম অঙ্ক, দ্বিতীয় অঙ্ক, তৃতীয় অঙ্ক... রাত্রি গভীর হয়... যবনিকা পড়ে।

কিন্তু শেষ হয় না। নিচুপাড়া, নতুন ফরিদপুর পাড়া, তিলিপাড়া, মুসলমান পাড়া, রামসীতা মাঠ, ফুটবল মাঠ, রুনুমামার ঢিবি। মঞ্চ জেগে থাকে। হাতছানি দেয়। তীব্র প্যাশন নিয়ে কিছু মানুষ, দর্শক আসন থেকে উঠে আসা কিছু তরুণ, সৃষ্টির যন্ত্রণা, আনন্দ, আবেগ নিয়ে ডায়াসে পা রাখে। মঞ্চ সাদরে জানায় আহ্বান। কালের অমোঘ নিয়মে নিভে যায় হ্যাজাকের আলো। ওয়াটের হিসাব রাখা বাল্ব জ্বলে ওঠে। এক নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

মঞ্চ জেগে থাকে মাটিয়ারি জুড়ে।


শঙ্কর মাস্টার 
বরুণদেব 

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত 

সুপ্রকাশ 

            

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।