শঙ্কর মাস্টার।। বরুণদেব।।

কলাবউ স্নান, যুদ্ধ যুদ্ধ সন্ধিপুজো, নবমী নিশির করুণ সানাই, ঘট বিসর্জন। এ জনপদে নদীর সাথে উৎসবের নিত্য আলাপন। দশমীর রাতে নদীর বুকে আলোকিত ভাসান, নৌকাবিহারে মা দুর্গার সান্ধ্যভ্রমণ, এপাড় ওপাড়। পঞ্জিকামতে মা দুর্গার প্রস্থান যাতেই হোক না কেন, এ গাঁয়ে দুর্গার কৈলাস গমন নৌকায়। চিরকাল। নদীপথে ভুটভুটি বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এ জনপদের ছেলেছোকরাদের দশমীর রাত, মা দুগ্গার ভাসান নৌকার পাশ দিয়ে চল-পানসি-এপাড়-ওপাড় 'ইয়াম্মা ইয়াম্মা, ইয়াম্মা ইয়াম্মা, এ খুবসুরৎ সামা, ব্যস আজ কি রাত হ্যায় জিন্দেগী, কাল হম কাঁহা তুম কাঁহা'।

সানাইয়ের করুণ সুরে দশমীর রাত ঘরে ফেরে। পুজো ফুরোয়। নারকেল নাড়ু, মুড়কি, বেসন দিয়ে তৈরী সিঁড়ির নাড়ু জিবে জল আনে। আর পুজোর ছুটির অবকাশে শঙ্কর মাষ্টার বই খুলে বসে। পুজোসংখ্যা নয়, যাত্রার বই। নতুন পালা। আবার মহড়া। আসছে শীতের যাত্রামঞ্চের ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং ঢং।

'গল্পদাদুর আসর' আর 'ছোট্ট বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা'-র 'শিশুমহল' চেটেপুটে খাওয়া আমাদের শৈশব- কৈশোর, যাত্রা প্যান্ডেলের ধুলোয় আমোদিত। রুইদাস পাড়ায় বাঁশঝাড়ের পাশ থেকে, সেনপাড়ায় সাহেবের আটা-তেলের কলঘর থেকে, আকাশবাণী কলকাতার মিডিয়াম ওয়েভে তরঙ্গায়িত মল্লভূমের 'লালবাঈ'। 'ও চাষিভাই, মাজরা পোকা হানা দিতে পারে রে'-র 'কৃষিকথার আসর' এর যাত্রাপালা শুনতে শুনতে ফুটবল মাঠ থেকে ফেরে বুধবারের বিকাল-সন্ধ্যা। পুজো-পার্বন উৎসবের দুপুরগুলোয় ল্যাম্পপোস্টে, প্যান্ডেলের বাঁশে টিকি বাঁধা অ্যালুমিনিয়ামের চোঙাগুলো গিরীশ ঘোষীয় রেনেসাঁস 'নটী বিনোদিনী' শোনায়- 'কৃষ্ণ বলে কাঁদো মা জননী, কেঁদো না নিমাই বলে/ কৃষ্ণ বলে কাঁদিলে সকলই পাবে/ কাঁদিলে নিমাই বলে নিমাই হারাবে/ কৃষ্ণ নাহি পাবে'।

আর পাড়ার মোড়ে মোড়ে 'এতদ্বারা মাটিয়ারির সকল জনগণকে জানানো যাইতেছে যে...' বাণেশ্বরীয় ঢ্যাঁড়ার শব্দে, 'আজকের যাত্রাপালা ঠিক রাত দশটায়' আসরাফীয় প্রচারে, পাড়াগুলি তোলপাড় হয় যখন, দল দঙ্গল 'জায়গা রাখিস' বলে কেরোসিন কুপীর আলোয় আলোকিত ডালার সামনে বিশ পয়সার এক ঠোঙা চিনেবাদাম কিনতে দাঁড়িয়ে পড়ে।

শঙ্কর মাস্টার 
বরুণদেব 

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত 

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।