শঙ্কর মাস্টার।। বরুণদেব।।

আসরাফ আলি গ্রীনরুমে সাজে। ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়, গালে রুজ চড়ায়, পরচুলোয় লম্বা বেণী ঠিক করে, ঘাঘরা পরে। আট রাতের যাত্রামঞ্চে, প্রথম বা শেষ রাতে আসরাফ আলি যাত্রা শুরুর আগে নটী সেজে নাচে। ফ্লুট বিউগল হারমোনিয়াম তবলা বাজে। দু'পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ছেলে বুড়ো সকলের আসরাফদা নাচে। রেশন দোকানের চাল-চিনি ওজনের দাঁড়িপাল্লা যে আসরাফ আলি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যাত্রা-নাটকের মেকআপের রঙ-তুলি যে আসরাফ আলি, মেলা খেলা থেকে উত্তম-সুচিত্রা-বিশ্বজিত-মাধবীর 'কালিকা টকিজ' পেরিয়ে প্রসেনজিত-চিরঞ্জিত-মহুয়া-দেবশ্রীর ভিডিও যুগের ক্যানভাসার যে আসরাফ আলি, ঈদমুবারক থেকে মহরমের জুলুস, সরস্বতী ভাসান থেকে রামনবমী মেলা, যে আসরাফ আলির কণ্ঠ ছাড়া উৎসব হয় না, উৎসব জমে না, সেই আসরাফ আলি ছাদফুটো ঘরের বর্ষা-পলিথিনে মাথা বাঁচিয়ে, জল ছপছপ উঠোনে সাদা ধুতি গুটিয়ে, বাংলা শার্টের পকেটে যাত্রার বই নিয়ে হেঁটে যায়। যে আসরাফ আলি এই জনপদ ছেড়ে গিয়ে পেশাদার যাত্রাদলে নাম লেখাতে পারে নি, কলকাতার অপেরা যাত্রার যন্ত্রের সুরে নটী আসরাফ হয়ে মঞ্চে নেচে চলে। বাইজীর ঠমক, খেমটার ঝলক, চাবুক খাওয়া নারীর প্রলয়, অসুরদলনী দুর্গা ঝড় হয়ে আছড়ে পড়ে মঞ্চে। বিভোর হয়ে নাচে আসরাফ আলি। হাততালিতে কানে তালা পড়ে। হর্ষে মাতে দর্শক। হর্ষে মাতে যাত্রামঞ্চ। হর্ষে মাতে রাম-রহিম, মহম্মদ-বাল্মিকী, লালন-চৈতন্য। ভোরের দিকে যাত্রা ভাঙে। মানুষ ফেরে ঘরে। ফজরের সুর মসজিদের আকাশ পেরিয়ে রামসীতা মন্দিরের চূড়া ছুঁয়ে যায়। এক হিরণ্ময় আলোয় ভরে যায় জনপদ।

মেলায় কলকাতার যাত্রাদল নির্ধারিত দিনের আগেই পৌঁছে যায় জনপদে। জমিদারের কাছারি বাড়ি, হাইস্কুলের ঘর আশ্রয় দেয় তাদের। হ্যাজাক আলোর যুগে রামনবমী মেলার যাত্রামঞ্চে প্রথম দু'এক রাত স্থানীয় নটদের। তারা স্থানীয়দের অভিনয় দেখে।

হ্যাজাকের আলোয় মাইক্রোফোনহীন মঞ্চের সেই সময়ে যুবক শিবশঙ্কর ব্যানার্জ্জী দলবল নিয়ে যাত্রায় মেতেছে। অনুজ শঙ্কর সে যাত্রায় সামিল। পাড়ায় পাড়ায় ছকু পণ্ডিত, মোহন চন্দ্র মিশ্র, ঘন্টু চক্রবর্তী, নারায়ণ বাবাজী... অনেক নাম, প্রবাহের নানান শাখা-প্রশাখা।

এমনই এক সময়ে শঙ্করের অভিনয় চোখ টানে ছোটফণির। যাত্রাজগতে তখন ছোটফণির নামডাক ছিল—আমার সঙ্গে চলে আয়, তোকে গড়ে পিঠে নেব।

হাত বাড়িয়ে দেন ছোটফণি। সে হাত ধরা হয়নি শঙ্কর মাস্টারের।


শঙ্কর মাস্টার 
বরুণদেব 

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত 

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।