অবিকল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শতঞ্জীব রাহা

আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা, সাহিত্যক্ষেত্রে স্বপ্রতিষ্ঠ মহিমায় উত্তীর্ণ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ— এগুলি একজন তরুণ লেখকের ক্ষেত্রে বাইরের স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই এসবের চিহ্নিতকরণ মানিকের পক্ষে সহজ ছিল। কিন্তু সময়ের চিহ্নসমূহ বস্তু পাথরে স্পর্শগম্য নয় বলে তাকে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না—তা ছিল আসলে মানিকের অতিমাত্রায় জিজ্ঞাসু ও সোৎসুক অস্তিত্বের সঙ্গে অনবচ্ছিন্নভাবে বিস্তৃত।

সে এমন এক সময় — (মানিকের জন্মকাল থেকেই যে সময়ের সূচনা আর তাঁর গোটা সাহিত্যজীবন জুড়ে যার ব্যাপ্তি। অন্ততপক্ষে সাহিত্যে মানিকের আবির্ভাব-লগ্ন থেকে প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৯৩৫-৩৬ সাল ও তারপর) যে সময়ের বৈশ্বিক-জীবন 'রক্তপ্লাবনে পঙ্কিল পথে বিদ্বেষে বিচ্ছেদে আচ্ছন্ন।' এই 'কালটি বিশ্ব-সংকটেরও একটি তমিস্রা ঘন পর্ব। এক মানিক জানিয়েছেন যে, জীবনকে তিনি ‘যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছিলেন 'অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেবার তাগিদে তিনি লেখেন। পুনশ্চ তাঁর দাবি ছিল : 'আমি যা জেনেছি এ জগতে কেউ তা জানে না।' (কেন লিখি) সময়ের, জীবনের যে ঘাতকতার শিকার মানিক হয়েছিলেন তার কথা আমরা সকলেই জানি, তাকে আমরা শুধু সূত্রায়িত করতে পারি:

১. প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার পূর্বেই যখন মাতৃবিয়োগ হয় (১৯২৮) তখন মানিকের বয়স ষোলো বছর।

২. তাঁর বাল্য, কৈশোর, বিদ্যালয় জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে বাংলা-বিহার- উড়িষ্যার নানা জায়গায়। স্থিতির অভাবটাই তার জীবনে স্বাভাবিক ও মজ্জাগত হয়ে পড়ে।

৩. সাব-ডেপুটি কালেক্টর পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগ্রামী আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসের স্বস্তিদায়ক সুবিধা ভোগ করে মানিকের অগ্রজরা তাঁদের জীবনে শিক্ষায়, প্রতিষ্ঠায়, আর্থিক উপার্জনে ঈর্ষণীয় সফলতা লাভ করেন। জ্যেষ্ঠাগ্রজ আবহতত্ত্ববিদ হিসেবে এবং মধ্যমাগ্রজ চিকিৎসক হিসেবে প্রশ্নাতীত সাফল্য লাভ করেছিলেন। এই পরিবারের ‘পারিবারিক ইতিহাসেও ক্রমে দেখা দেয় ব্যবহারিক সাফল্যের সঙ্গে পরস্পরসম্পৃক্ত বিকার ও বিচ্ছিন্নতা।' বিগত শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশক থেকেই বাঙালি শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির প্রবাদপ্রতিম একান্নবর্তী পারিবারিক সৌহার্দের চিরাচরিত ছবিটি স্বার্থসংঘাতের আঘাতে কিছুটা ম্লান হয়ে এসেছে।
এই বিকার এমনই, যে তা মধ্যবিত্তের আত্মকেন্দ্রিকতার সার্বিক চেহারা নিয়ে দেখা দেয় মানিকের জীবনে। নিজেরই পারিবারিক জীবনের পটভূমিকায় প্রথম যৌবনের আগেই মধ্যবিত্তের জীবনদর্শন পাঠ করতে হয় তাঁকে। সেই জীবনদর্শনের পাঠদাতাদের কাছ থেকে কীভাবে এই শিক্ষা পেয়েছিলেন মানিক তা দেখে সংক্ষেপে নেওয়া যেতে পারে :

অবসরগ্রহণের বছর কয়েক পর হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় স্থায়ীভাবে কলকাতা(য়) আসেন এবং পেনশন-প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চিত টাকায় বাড়ি তৈরির জন্য জমি কেনেন টালিগঞ্জ অঞ্চলে — টালিগঞ্জ-দিগম্বরীতলার নিজস্ব বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হয় সম্ভবত ১৯৩৭-এর শেষভাগে। তাঁর প্রথম দুই পুত্র যদিও কর্মসূত্রে আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তবু পরবর্তী তিন পুত্রের ক্রমবর্ধমান যৌথ সংসার, পৈতৃক গৃহের নিরাপদ ছত্রছায়ায়, একটানা এগারো বছর অব্যাহত থাকে, কিন্তু পারিবারিক ভাঙন চূড়ান্ত হবার আগেই, বৃদ্ধ পিতা তাঁর সমস্ত জীবনের সঞ্চিত বিচক্ষণতা নিয়েই, তাঁর নিজস্ব বাড়ি বিক্রি করে দেন ১৯৪৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসে এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে নিজেই শেষপর্যন্ত উদ্বৃত্ত হয়ে পড়েন।হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত অবসর এইবার শুরু হয়। আত্মপ্রতিষ্ঠ পুত্রদের সংসার থেকে সংসারে কিছুকাল হস্তান্তরিত হবার পর পরিত্যক্ত পিতা তাঁর অবশিষ্ট জীবনের আশ্রয়ের জন্য তাঁর লেখক-পুত্রের কাছেই চলে আসেন। ১০ তারপর সাত বছর মানিকের মৃত্যু পর্যন্ত দারিদ্র্য, স্থানাভাব (বরাহনগরে দু-কামরার ভাড়াবাড়িতে একটি ঘরকে সস্তার ক্যানভাসের পার্টিশন দিয়ে ভাগ করে পিতাপুত্র থাকতেন। সেই আধখানা ঘরই ছিল মানিকের লেখার শোয়ার বসবার ঘর), রোগ, অস্বাস্থ্য, বিচ্ছিন্নতা ও শূন্যতার পদাবলির এক অসম্ভব বারোমাস্যা।

৪. মানিকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী তিনি ১৯৩৫-এর মধ্যেই, লেখকজীবনের পূর্ণ-প্রতিষ্ঠার কাল ভালোভাবে সূচিত হওয়ার আগেই মৃগী বা এপিলেপ্সি রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগ থেকে তিনি মৃত্যুর পূর্বে আর নিষ্কৃতি পাননি। রোগমুক্তির উপায় চিন্তা আর তার উপশমের চেষ্টা তাঁকে জীবনযাপনের এক ব্যর্থতা থেকে আর এক ব্যর্থতায় নিয়ে যেতে থাকে। ক্রমিক আর্থিক অসম্পন্নতার আঘাত, অর্থের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম, বাধ্যতামূলক বহুপ্রসূতা— সব মিলিয়ে আমৃত্যু এক অলাতচক্রে পাক খেয়েছেন মানিক।

এমনকি পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়-নির্মিত দিগম্বরীতলার যৌথ পরিবারে থাকাকালীনই এপিলেপ্সি আক্রান্ত মানিক ধারাবাহিক ও উন্নতমানের চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য পুনার উচ্চপদস্থ আবহতত্ত্ববিদ জ্যেষ্ঠভ্রাতার কাছে একবছর ধরে মাসিক একশত টাকা আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলেন। এ-প্রসঙ্গে মানিক জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে লিখেছিলেন : 'আপনার পক্ষে মাসিক একশত টাকা দেওয়া কিছুই নাহে।'

৫. অনারোগ্য অসুস্থতাই সম্ভবত মানিককে নেশাগ্রস্ততাজনিত এক আপাত উৎকেন্দ্রিকতার মধ্যে নিক্ষেপ করে। সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে এসব কিছুই হয়ে দাঁড়ায় অনতিক্রম্য বাধা। অথচ তাঁর মনে হয়েছিল। যে, সাহিত্যে প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যই তাঁকে অতিমাত্রায় পরিশ্রম করতে হয়েছে, আর এই পরিশ্রমই তাঁর রোগের কারণ। রোগের সূত্রেই তিনি অতি-প্রত্যক্ষভাবে মধ্যবিত্তসমাজের প্রত্যক্ষ ও সমাজবিজ্ঞানগত অন্তর্বিরোধকে দেখতে পান—পারিবারিক ভাঙন, স্বার্থপরতাকে একেবারে সরাসরি উপলব্ধিও করেন। মানিক তাঁর রচনার বহির্কাঠামো আর অন্তর্বরনের সর্বত্র মধ্যবিত্তের যুগোচিত ও ঐতিহাসিক ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর পোশাকের আড়ালে মধ্যবিত্তের যাপনের নগ্নতাকেও চিত্রিত করেছেন সমান দক্ষতায়। তবু সাহিত্যকে তিনি ছাড়তে পারেন না তো বটেই, লেখার ক্ষেত্রে সামান্য শ্লথগতিও অবলম্বন করতে পারেন না। দু-দুবার চাকরিতে যোগ দেন, একবার নিজেই প্রকাশনী খুলে বসেন। ১৯৩৭-এ মাসিক ও সাপ্তাহিক 'বঙ্গশ্রী' পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন, ইস্তফা দেন ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে কিছুকাল ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টে কাজ করেন। ভাই সুবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উদয়াচল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস নামে মুদ্রণালয় ও প্রকাশনা স্থাপন করেন। বস্তুত সাহিত্যই তাঁকে ছাড়ে না— 'যুগসংকটের তীব্রতম লগ্নে’, ব্যাঘাত-বিঘ্নতার দায়মালী জীবনেও ‘শুধু লেখক' হবার অভীপ্সা আর বাধ্যতা মহত্তর কোনো উজ্জ্বল প্রবুদ্ধতার দিকে তাঁকে ইশারায় আহ্বান করেই চলে। দায় আর বাধ্যতাকে মেলানো কঠিন বলেই আমৃত্যু অনুশীলনে জীবন কেটে যায় তাঁর মতো লেখকেরও।

ফলত কোনোরকম চেষ্টাকৃত আরোপণ ছাড়াই মানিকের রচনায় সময়ের, সমাজ- সংসারের বস্তুপরিচয়ের প্রামাণ্যতা থেকে যায়। তাঁর রচনার রসায়নে দ্রবীভূত হয়ে থাকে আবহকালের পরম্পরা থেকে জাত বিশ শতকের কয়েক দশকের ভারতীয় তথা বাঙালি জীবনের সত্য পরিচয়। সেই সত্য এতটাই নিখাদ যে, মানিকের আত্মনিরীক্ষার সেই সব উপাদানকে ব্যবহার করে অর্থনীতিবিদ সমাজতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক অনায়াসে সময়ের পুনর্নির্মাণ করতে পারেন।

সমকালের সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পৃক্ততার অপর আর একটি প্রান্ত স্পর্শ করে থাকে তাঁর মতাদর্শগত বিশ্বাস, সময়কে বোঝার প্রচেষ্টা-তাড়িত তাঁর তাত্ত্বিক ও সক্রিয় কর্মকাণ্ড—দিগন্তের মতোই তার মাটি ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা, দিগন্তের মতোই তার মাটি ছুঁতে না-পারা বিস্তার।

বিজ্ঞানমনস্কতা, দেশীয় ও বিশ্বপরিস্থিতি মানিককে বৈজ্ঞানিক বিশ্ববীক্ষায় আকৃষ্ট করেছিল। একদিকে বিজ্ঞানমনস্কতার সূত্রেই সময়প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গেই বস্তুজগতের অন্তরে-বাইরে নিরন্তর ক্রিয়াশীল বিরোধের কথা তাঁর জানা হয়ে যায়। আর অন্যদিকে প্রাণপ্রবাহ-বিধৃত জীবনধারাকে অনুধাবন করতে গিয়ে প্রকৃতি ও প্রাণ—জীবন ও জৈবিকতার সদরে-অন্দরেও সর্ববিরোধময় পটভূমিটির সন্ধান পান তিনি। উপলব্ধির এই বাঁকের মুখে দাঁড়িয়েই মানিক সমাজকে, আপাদমাথা সামাজিক মানুষকে এবং সময়-বিধৃত জগৎ ও জীবনকে অনুধাবন করবার জন্য বৈজ্ঞানিক বিশ্ববীক্ষাকে সবচেয়ে সহায়ক বলে মনে করেছিলেন। (লেখকের কথা)। সে-সময় দেশীয় ও বিশ্বপরিস্থিতির বাস্তবতা বিশ্বের মহৎ মননচর্চাকারী মানবতাবাদীদের সংবেদনশীল ও বিবেকী অংশটিকে আকর্ষণ করছিল ক্ষমতার অসহ- দাপাদাপির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত প্রগতিপন্থার দিকে। সন্দেহ নেই যে, বৈজ্ঞানিক বিশ্বীক্ষার অনুধ্যান, আর স্বনির্বাচনের স্বভাবিত যাত্রাপথই মানিককে সাংগঠনিক সক্রিয়তায় আকর্ষণ করেছিল। ১৯৪৪ সাল নাগাদ সাংগঠনিক সদস্যপদ গ্রহণ সেই সময়ের বিচারে কোনো অভাবিত চমক ছিল না। স্বাধীনচিত্ততা ও প্রাতিস্বিকতায় মর্মমূল-বিশ্বাসের সঙ্গে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার টানাপোড়েন— নিয়মমাফিক কর্মক্রিয়ায় সংকীর্ণতার বিঘ্ন, দৈনন্দিন যাপনের বাস্তবতার সঙ্গে মতাদর্শলালিত জীবনের বহির্কাঠামোর দূরত্ব, কিছুটা সাংগঠনিক যত্নহীনতার আঘাত, শারীরিক এবং নেশাজনিত অসুস্থতা থেকে মুক্তির আকুতিতে অনতি-জীবনের শেষ- পর্যায়ে অতীন্দ্রিয়তার প্রতি সাময়িক হৃদয়-দৌর্বল্যের প্রকাশ সত্ত্বেও— বিরোধদীর্ণ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানিক কর্মের পথনির্দেশিকা হিসেবে নিজের মতাদর্শকে, আর তার সঙ্গে সাংগঠনিক সদস্যপদটিকেও রক্ষা করেছিলেন। রক্ষা করতে পেরেছিলেন নিজের রচনায় জগৎ ও জীবনের সর্বস্তরে দ্বান্দ্বিকতার উপস্থিতিকে চিহ্নিতকরণের বিশ্বস্ততাকেও।

সময়ের মুদ্রা, মানিক ও সাহিত্যের জন্ম
...................................................
অবিকল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
শতঞ্জীব রাহা

প্রচ্ছদ : শোভন সরকার
মুদ্রিত মূল্য : ৫০০টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।