বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

বাড়ি বাড়ি লম্ফের নানা প্রকারভেদ ছিল। লম্ফ দিয়ে চেনা যেত বাড়ির আর্থিক পরিস্থিতি। যাদের অবস্থা ভাল তাদের পিতলের লম্ফ। এ লম্ফেরও নানা প্রকার। কোনওটা গোল। কোনওটা লম্বাটে, সুদৃশ্য ছাঁদের দীপদান। সাধারণ গৃহস্থের ঘরে টিনের বা কর্কেটের লম্ফ। যাদের অবস্থা আরও খারাপ তারা ওষুধের বা অন্য কিছুর কাচের শিশিতে পলতে লাগিয়ে লম্ফ বানিয়ে নিত। লম্ফের স্থান সাধারণত দাওয়ায়। গোয়ালঘরে। বা উঠোনের কাঠের উনুনশালের কাছে। এর কারণ বোধহয় লম্ফের ধোঁয়া। হারিকেনের থেকে একটু বেশি ধোঁয়া বেরত লম্ফ থেকে। তাতে ঘরে ঝুল জমত। তাই ঘরে ঠাঁই হতো না লম্ফের। 
কল থাকলে বিকল হবেই। হারিকেনের তো কল-ই ছিল। কলকা বলতাম আমরা। পলতে বাড়ানো কমানোর কল। সেটা বিগড়ে যেত। কারও পলতে বাড়ানো কমানো যেত না। প্রয়োজন না থাকলে হারিকেনের আলো মৃদু করা হতো পলতে কমিয়ে। তাতে কেরোসিন বাঁচত। কল খারাপ হলে বাড়াতে কমাতে গিয়ে হারিকেনের নীচের তেলের ডাব্বায় সেঁধিয়ে যেত পলতে। তা বার করা এবং পুনঃস্থাপন ছিল ঝক্কির। কোনও হারিকেনের কাচ লাগানো যেত না। খাপ আলগা হয়ে ঢলঢল করত। আর হারিকেন, লম্ফ নির্বিশেষে তেল চোঁয়ানোর রোগে ধরত বয়সকালে। মানে ব্যবহারে জীর্ণ হলে। তেল চোঁয়ানো হারিকেন বড় অস্বস্তিকর। গন্ধ ছড়ায়। চাটাই নোংরা করে। চাটাইয়ের তেল পড়া জায়গায় বসে পড়লে প্যান্টে গন্ধ। হাত পড়লে খাওয়ার সময়ে অসুবিধে। আর বই ঠেকে গেলে ব্যাগময়। পরদিন স্কুলে বন্ধুদের কাছে গন্ধগোকুল হওয়ার আশঙ্কা। তেল পড়া হারিকেন নিয়ে পড়তে গেলে টিউশনের স্যারেরাও ক্ষেপে যেতেন। সারাতেই হতো। ইস্কুলের বারান্দার মানুষটার কাজ জমত ভালোই। সারাদিন বসে বসে নানা ধরনের দীপদান সারাতেন মানুষটা। আর ওর স্ত্রী বাড়ি বাড়ি ঘুরে হারিকেন, লম্ফ জোগাড় করে আনতেন। 
অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রও সারাতেন তিনি। গ্রামে তখন স্টিলের বাসনপত্রের তত চল হয়নি। ধান জ্বাল দেওয়ার, ভাত রান্নার, জল গরম করার হাঁড়ি বাড়িতে বাড়িতে। আর থাকত সসপান, বাটি, গেলাস।
ইস্কুলে একটু আগেভাগেই পৌঁছতাম। শুরুর ঘণ্টা পড়ার আগে ভদ্রলোকের  সারাই করা দেখতাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বাড়ির বড়রা অনেক চেষ্টা করেও দীপদানের যে সব রোগ সারাতে পারত না সেগুলো অনায়াসে সারিয়ে দিতেন মানুষটা। দাঁড়াতে দাঁড়াতে একটু একটু করে সাহস হচ্ছিল। সাহস থেকেই একদিন জিজ্ঞাসা করা, ‘‘কোথায় বাড়ি তোমাদের?’’ ভদ্রলোক বোধহয় একটু একটু বাংলা জানতেন। না হলে গ্রামে কাজ করতে পারতেন না। আমাদের হিন্দি বলার কোনও প্রশ্ন নেই। গ্রামের লোকেদের হিন্দিও তথৈবচ। মানুষটা আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, ইলাহাবাদ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র আমাদের কাছে তখন ইলাহাবাদ, ইম্ফল একই। বাংলার বাইরে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম। ফলে উল্লেখযোগ্য কিছু মনে হয়নি।
মনে হয়েছিল এক বা দু’দিন পরে। প্রসঙ্গ ভুলেছি সাড়ে তিন দশক পরে। এটুকু মনে আছে, ভদ্রলোক বলেছিলেন, তাদের বাড়ির কাছে অমিতাভ বচ্চনের বাড়ি। প্রাথমিক স্কুলে পড়লেও বচ্চনকে চেনা হয়ে গিয়েছিল। কাকার বাড়ির ক্যাসেটে, বাড়িতে মাঝে মাঝে আসা খবরের কাগজে, বড়দের মুখের আলোচনায় সিনেমা জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে গিয়েছিল। বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, জিতেন্দ্র, রেখা, শ্রীদেবী, জয়াপ্রদা পরিচিত মুখ। আগ্রহ, আকর্ষণও ছিল। তাঁরা সব মায়াবি জগতের বাসিন্দা। সেই রকম কারও বাড়ির কাছে থাকে এরা! উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘দেখেছো?’’ ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘‘এখন তো বোম্বেতে থাকে। মাঝে মাঝে আসে।’’ বাড়ি ছেড়ে কেন বোম্বেতে থাকে! আশ্চর্য হয়েছিলাম!
 

অমিতাভ বচ্চনের দেশের লোক
দীপক দাস

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।