বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

নবাব আলিবর্দী খাঁ তাঁর রাজত্বকালের সিংহভাগ সময় কাটিয়ে দিলেন ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে’-র মোকাবিলা করতে করতে। বর্গী আক্রমণে ছারখার হয়ে যাওয়া বাংলায়, কাঁসারিরা এক মহল্লা থেকে আর এক মহল্লায় বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হল। গড়ে উঠল নতুন নতুন পিতল-কাঁসা অঞ্চল। গঙ্গারামের ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’-এ বর্গী আক্রমণের ভয়াবহতা—
কোনো কোনো গ্রাম বর্গী দিল পোড়াইয়া
সেসব গ্রামের নাম শুন মন দিয়া
চন্দ্রকোণা মেদিনীপুর আর দিখগপুর
খিরপাই খড়ার আর বদ্দমান সহর।
মেদিনীপুর পুড়িয়ে বর্গীরা চলে গেল হুগলির দিকে। হুগলি অঞ্চল থেকে কিছু কাঁসারি পরিবার বর্গীর হাত থেকে বাঁচতে চলে এল মেদিনীপুর। স্থানীয় কাঁসারিরা হাত মেলাল। বর্গী হানায় ছারখার হয়ে যাওয়া খড়ার হয়ে উঠল এই শিল্পের পীঠস্থান। বর্গী হানা থেকে বাঁচতে মুর্শিদাবাদের বড়নগর, ধননগর অঞ্চল থেকে পিতল-কাঁসা শিল্প ছড়িয়ে পড়ল খাগড়া, কান্দি, জঙ্গিপুর, পাঁচগ্রাম, জিয়াগঞ্জ, বীরভূমের টিকারবেতা, পাথরকুচি, নদিয়ার নবদ্বীপ, মুড়াগাছা। শিল্পের অভিমুখ গেল বদলে। অভিজাত সম্প্রদায়ের আভিজাত্য ছেড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় বাসনকোসনের গার্হস্থ্যে পরিণত হলো শিল্প। ব্যবসা বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ল। পরিবহণ মূলত নদীপথে। নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদ কলকাতার মধ্যে এক ক্যানাল। সেই জলপথে মুর্শিদাবাদের কাঁসা-পিতল কলকাতায় বাজারজাত হতো । ভাগীরথীর বুকে বজরায় বর্ধমানের দাঁইহাটের কাঁসারিদের কাঁচামাল, উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর চলাচল।
ভাস্কর পণ্ডিতের তরবারি বদলে দিয়েছিল এক গ্রামকে। নদীয়া জেলার মাটিয়ারি। কৃষি অর্থনীতির পিতল-অর্থনীতিতে রূপান্তর। ভাগীরথীর দুই পাড়ে দুই বসতি- দাঁইহাট  আর মাটিয়ারি। ইন্দ্রাণি পরগণার দাঁইহাট এক সচ্ছল শহর যার অর্থনীতির বিকাশের মূলে পিতল শিল্প। কোচবিহার থেকে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষরা দাইঁহাটে এসে বসবাস শুরু করে। গড়ে ওঠে রাজবংশী পাড়া। এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে শুরু হয় পিতল-কাঁসার কাজ। বিহার উত্তরপ্রদেশ থেকে কাঁচামাল আসে নদীপথে। ঢালাই, পেটাই, পালিশের কারিগররা তৈরি করে লোটা ঘটি জগ বালতি হাঁড়ি হরেক রকম বাসনকোসন। নদীপথেই বাজারজাত হয়। সময়টা মুঘল আমল। ১৯১৩-র দিকে দাঁইহাটে রেলপথ হলো যখন, এ শিল্প বিদায়ের ঘণ্টা বাজাতে শুরু করেছে।
নদীর মতোই ইতিহাসের প্রবাহ বদলায়। শিল্পের প্রবাহও। ভাস্কর পণ্ডিত এসে ঘাঁটি গাড়ে দাঁইহাটে। বর্গী হানায় ছারখার হয় ইন্দ্রাণী পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চল—
আতাইহাট পাতাইহাট আর দাঞিহাট
বেড়া ভাওসিংহ পোড়াএ আর বিকিহাট
এইরূপ ইন্দ্রহিন পরগণা বরগি লুটি
কাগা মোগাএ লুটি ওলন্দাজের কুটি।
গঙ্গারাম ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’-এ এই অত্যাচারের যে রোমহর্ষক বর্ণনা দিচ্ছেন, তাতে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দের  বখতিয়ার খিলজির মুসলিম তরবারির সাথে ১৭৪৪ এর ব্রাহ্মণ ভাস্কর পণ্ডিতের হিন্দু তরবারির পার্থক্য কিছু নাই আমজনতার কাছে। সাম্রাজ্যের তরবারিই হোক বা রাষ্ট্রের মিসাইল, ধার্মিক হয় না কখনো। তরবারির ধর্ম রক্ত, লুঠতরাজ, ধর্ষণ। বর্গীর হানাও সধর্মেই দুঃশাসন হয়—
ভালো ভালো স্ত্রীলোক যত ধইরা লইয়া জাএ
আঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলাএ
একজন ছাড়ে তারে আর জনা ধরে
রমনের ভারে ত্রাহি শব্দ করে।
মৃত্যুভয়ে, মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষায়, কাঁসারিরা দাঁইহাট ছাড়তে বাধ্য হয়। কিছু কারিগর চলে যায় কলকাতার সিমলে অঞ্চলে, সেখানে গড়ে তোলে কারখানা। আর একটা অংশ চলে আসে ভাগীরথীর অপর পাড়ে, মাটিয়ারিতে। কৃষিজীবী  মাটিয়ারির পিতলজীবী মাটিয়ারিতে রূপান্তরিত হবার পথে প্রথম নৌকাটি নোঙর করে খেয়াঘাটে। স্থানীয় জমিদার, বিত্তশালী ব্যবসায়ীরা জোগায় মূলধন। মাটিয়ারিতে শুরু হয় পিতলের কাজ।
‘রেতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে বেঁচে আছি’-র বাংলায়, বিশ শতকের দুইয়ের দশকে কলেরা ম্যালেরিয়া দাঁইহাটে মহামারি রূপে দেখা দিলে, যেটুকু পিতল শিল্প টিকেছিল সেখানে, তাও আর রইল না। পিতলজীবী মাটিয়ারি হওয়ার পথে শেষ নৌকাটি নোঙর করল মাটিয়ারি ঘাটে। তারা দূরে কোথাও যেতে চাইল না, কেননা, ততদিনে মাটিয়ারিতে পিতলশিল্পের পরিকাঠামো মোটামুটি গড়ে উঠেছে। তার ওপর রয়েছে ভাগীরথীর জলপথে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের পরিবহণ। বর্গী আক্রমণে বা মহামারির থাবায় সন্ত্রস্ত কাঁসারিরা আর কখনও ফিরে যায়নি দাঁইহাটে। পিতল-কাঁসার ঠুংঠাং পাড়াগুলি ক্রমশ বোবা হয়ে গেল। এতটাই যে, শহর দাঁইহাটে একটিও কাঁসা-পিতলের দোকানের অস্তিত্ব নেই আজ।
অপরদিকে মাটিয়ারির ঘুম ভাঙে হাতুড়ি-নোঙালি-পিতলচাকি-ফাসার আলাপনে। মাটিয়ারি রাত জাগে রোলিং মেশিনের ঘরঘর শব্দে। ১৮৮০-৮২-র দিকে ইংলণ্ডে তৈরি পিতলের চাদর কলকাতার জাহাজঘাট থেকে কিনে নিতেন মাটিয়ারির ব্যবসায়ীরা। পুরো জাহাজের মাল বড়ো বড়ো বজরায় এসে পৌঁছাতো মাটিয়ারির ঘাটে। কাঁসারিরা তৈরি করত নানা রকমের জগ, বালতি, গামলা, ঘড়া, বাঙালি হাঁড়ি, ঘটি, পুষ্পপাত্র। নদীপথে পৌঁছে যেত বাজারে—পূর্ণিয়া, ভাগলপুর, রাজশাহি, কলকাতা, নানা প্রান্তে। রেড়ির তেলের প্রদীপ, সেজবাতির যুগ পেরিয়ে যে জনপদে বিশ শতকের প্রথম দশকে ‘মেড ইন ইংলণ্ড’ ছাপমারা হ্যারিকেন পৌঁছেছিল জমিদার বাড়িতে, মানুষ যাকে বলত ‘হরিকল’, সেই জনপদের আলোর বিবর্তন পিতল শিল্পীদের হাত ধরে। হরিকলের তিন দশক পরে গড়ে উঠল পেট্রোম্যাক্সের কারখানা। কাঁসারিদের হাত ধরে পেট্রোম্যাক্সের আলোয় মাটিয়ারি আধুনিক হলো। কাঁসারিরা তৈরি করল গ্যাস-স্টোভ। কয়লা-কাঠের রান্নাঘর আভিজাত্য পেল। একদিন ফিলামেন্ট বাল্বের আলোয়, জেনারেটরের ফটফট আওয়াজে, পেট্রোম্যাক্সের ম্যান্টেল গেল নিভে। সস্তা জনতা স্টোভের পলতে নিভিয়ে দিল পিতলের স্টোভ।      

কাঁসারি কথা
সোমনাথ

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।