আহাম্মকের খুদকুড়ো ।। দুর্লভ সূত্রধর।।


'আমাদের ইস্কুল ছিল প্রকৃত অর্থেই প্লেটোর নগররাষ্ট্রের থেকেও এক আদর্শ রিপাবলিক। উকিল-মোক্তার-ডাক্তার-অফিসার থেকে শুরু করে ছোটো ব্যবসাদার-ভেণ্ডার-বাজারের তরকারি বিক্রেতা-রিক্সাচালক-পরিচারিকা-সব পরিবারের ছেলেরাই আমাদের ইস্কুলে পড়তো। রুশ লোককথার 'দাদুর দস্তানা'র মতো সকলের সেখানে ঠাঁই ছিল। শহর-লাগোয়া আশেপাশের গ্রামগুলির জুনিয়ার হাইয়ের ছেলেদেরও আশ্রয় ছিল আমাদের আমজনতার বিদ্যালয়টি। যথাসম্ভব অনভিজাত হওয়ায় আমরা আমাদের ইস্কুল নিয়ে নিশ্চিন্ত আরামে ছিলাম।

সেবার বছরের মাঝখানে একটি ছেলে এসে আমাদের ওপরের ক্লাসে ভর্তি হলো। নতুন কোনো ছেলে ভর্তি হলে তখন কিছুকাল সে গোটা ইস্কুলের কৌতূহলী নজরে থাকত। শোনা গেল সে নাকি আমাদের শহরে নবাগত উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারের পুত্র। বড়ো সরকারি অফিসার, বছরের মাঝখানে বদলি হয়ে এসেছেন বলে তাঁর ছেলে নিয়মমাফিক বছরের মাঝখানেই ভর্তি হতে পেরেছে।

সকলের সঙ্গে আমরাও উঁকি দিয়ে নবাগত জীবটিকে দেখে নিলাম।

নেহাৎই গোলগাল ভালোমানুষ চেহারা, সুমধুর ও আন্তরিক ব্যবহার—শুধুমাত্র পোশাকে ঈষৎ বড়োমানুষী।

কারোর দিকে তাকিয়ে ঈর্ষা করবার মতো আত্মবোধের চর্চা ছিল কম। বরং এমন একজন শহরের এত স্কুল থাকতে আমাদের এই 'গোষ্ঠগৃহে' ভর্তি হওয়ায় আমাদের বেশ একটা গর্বিত-আনন্দই হলো বলা যায়।

সুমিতাভদা মুখ খুলতে বোঝা গেল—সামান্য একটু ত - ত করে কথা বলে সে। এক ক্লাসের সিনিয়ার দাদা—হাসাহাসি তো আর করতে পারি না! বরং তার সঙ্গে ভাব জমানো চেষ্টায় খামতি রাখেনি কেউ।

কয়েকদিনের মধ্যেই সুমিতাভদা ইস্কুলে বিখ্যাত হয়ে গেল, এবং তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অকল্পনীয় এক কারণে।

সেদিন টিফিন পিরিয়ডে আমরা অন্যদিনের মতো ইস্কুলের ভাঙা পাঁচিলে বসে কেউ চালভাজামাখা চিবোচ্ছি কেউ-বা ঘুগনির শালপাতা চাটছি প্রাণপণে, কেউ কেউ সেসব না-পেয়ে অথবা শেষ করে এর-ওর হাতে ঠোক্-পাড়ার পর একটু দৌড়োদৌড়ি করছি—এমন সময় সুমিতাভদাকে দেখে আমাদের ক্লাসের মাণিক্য (ওর আসল নাম ছিল মানিক, কিন্তু ক্লাসে আরও দু-চারটি মানিক থাকায় প্রখরবুদ্ধি মানিকের এমনধারা নামকরণ হয়েছিল, যেমন অস্বাভাবিক বলশালী আর-এক মানিকের নাম ছিল শক্তি-মানিক ইত্যাদি) সুমিতাভদার দিকে হাতের চালছোলা ভাজার ঠোঙা বাড়িয়ে দিয়ে একটু খাওয়ার অনুরোধ জানাতেই সুমিতাভদা দাঁড়িয়ে পড়ে নাভির ওপর বাঁ হাতটা রেখে বলে উঠল বেশ নাটকীয়ভাবে—'পেতে আজ জাগা নেই রে।'

সে বয়সে আমাদের সবার পেটেই সারাদিন খাণ্ডবদাহন, আর ওর পেটে জায়গা নেই। কী ব্যাপার!

—'কেন কেন? জাগা নেই কেন?'

—'জানিস, আজ গোতা গোতা দুতো দুতো দিম খেয়েছি।'

উরি ব্বাস্! গোটা ডিম! তা-ও আবার দুটো, একসঙ্গে!

অতি দ্রুত 'সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে'—সুমিতাভ গাঙ্গুলি আজ গোটা গোটা দুটো দুটো ডিম খেয়ে ইস্কুলে এসেছে। সবাই, সব ক্লাসের ছেলেরা রুদ্ধবাক্ হয়ে সুমিতাভদাকে ঘুরে ঘুরে দেখে যেতে লাগল।
শোনা গেল সুমিতাভদার ক্লাসের বন্ধুরা তাকে ঘিরে ধরে একসঙ্গে দুটো গোটা ডিম খাওয়ার অনুপুঙ্ক্ষ বিবরণী আদায় করে ছেড়েছিল।

আমাদের কাছে বহুকাল সে বিস্ময় জীবন্ত ছিল।

অনেককাল পরে বাইরে পড়তে গিয়ে ছেলেদের হোস্টেলে প্রথম গোটা গোটা ডিম খেতে দেখি। তখনও মেয়েদের হোস্টেলে অর্ধেক ডিমই চলছে, তাকে তবলা ভক্ষণ বলে ছেলেরা ঠাট্টা করত। সংগতি না থাকায় হোস্টেলে ঠাঁই হয়নি। 'গেস্ট মিল' খেতে গিয়ে প্রথম গোটা ডিম কীভাবে খেতে হয় তা জানতে পারি। প্রথমদিন বেশ সাবধানে গোটা ডিম ভেঙে একটু একটু করে খেতে শিখি। তখনও একসঙ্গে 'দুতো দুতো দিম' খাওয়া আর হয়ে ওঠেনি।

যখন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বাস্তবে দেখা দিল, তখন স্বাস্থ্যের কারণে ডিম খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়েছে।
.
.
.
আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : দুর্লভ সূত্রধর

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।