আহাম্মকের খুদকুড়ো।। দুর্লভ সূত্রধর।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের বই 'আহাম্মকের খুদকুড়ো' পড়ে লিখেছেন মহুয়া বৈদ্য। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.............................................................................

“...তখন আমাদের গাঁয়ে ছিল ঝুপো ঝুপো ঘন বাঁশবন। এমন এক বাঁশবনের ধারে ছিল শেয়ালখেকো জোহরার বাড়ি…” এইটুকু মুখবন্ধ করে বাবা সেদিন সন্ধ্যার গল্পের আসরে আমাদের দিকে হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে রইলেন। তারপরের গল্প অবশ্য আদায় করে ছাড়লাম… জোহরা যখন এইটুকুন, সবে তার আকিকা হয়েছে, এইসময় এক সন্ধ্যে বেলায় সে দোলায় ঘুমাচ্ছিল। এমন সময় এক শেয়াল এসে তার সদ্য নেড়া করা মাথাটি মুখের মধ্যে পুরে নিয়ে সবে কামড় বসাতে যাচ্ছে, এমন সময় সবাই হইহই রইরই করে উঠলে বেচারী শেয়াল পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। গাঁয়ের কবরেজের নিদান অনুযায়ী বাঁশগাছের সবুজ ছাল নতুন শিলে শিশির দিয়ে বেটে জোহরার মাথায় লাগানো হয়। ওর মাথায় শেয়ালের দাঁতের আঘাতে ক্ষত তৈরি হয়েছিল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক সবকিছু পালটে যায়। আমাদের সেই গল্প শোনার কালও গেছে। বহুদিন পর সেইসব সন্ধ্যার আঘ্রাণ যেন এক লহমায় ছুঁয়ে দিল দুর্লভ সূত্রধরের লেখা “আহাম্মকের খুদকুড়ো” বইটি। 
“তাহাকে শেয়ালে খাইয়াছে” পড়া শেষ করার সাথে সাথে আমি যেন বুঝে গেলাম, এ এক অনবদ্য টাইম ট্রাভেলে প্রবেশ করতে চলেছি, যেখানে একসাথে জড়িয়ে-মড়িয়ে রয়েছে আমার আর আমার বাবার শৈশব থেকে বড় হয়ে ওঠার গল্প। এর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে সেই সব বিরল সন্ধ্যারাত্রিদিন যখন আমরা বাবার কাছে গল্প শুনতে বসতাম। বইটি পড়তে পড়তে বার বার থমকেছি… আরে! এ তো সেই গল্প, বাবা যেদিন এই গল্প বলেছিলেন, সেদিন খুব ঝড় আর শহর জুড়ে লোডশেডিং… 
সাধারণের চেয়ে সাধারণ হয়ে বেঁচে থাকার একটা আলাদা মজা আছে। পথের ধুলো যেমন…রোদ পেল তো ফুরফুরে হয়ে খানিক উড়ে গেল, জল পেল তো কাদা হয়ে পড়ে রইল। বলতে এমন সাদামাটা  লাগলেও এই ধুলোকাদার ভ্রমণ অভিজ্ঞতাটি বড় বেশী সোঁদা গন্ধে ভরা। “আহাম্মকের খুদকুড়ো” জুড়ে সেই সোঁদা মাটির গন্ধের টান। টানাটানির সাধারণ এক সংসারে প্রতিটি মুহূর্তে যে আশ্চর্য রূপকথার জন্ম হয়, তার পরিপাটি বর্ণনা বইটির প্রতিটি পাতায় মায়া ছড়িয়েছে। দিদিমার হাতে সাবু-মাখা, খুদের তৈরি ফ্যানা-ভাত, লেবুপাতা চটকে মেখে দেওয়া পান্তা- ভাত, মাখন লাগানো তেকোণা পাউরুটি…এসব সেই রূপকথার সাম্রাজ্যের রাজভোগ। অনেকদিন আগে, তখন আমার ক্লাস থ্রী, আমার দিদা সেবার আমাদের বাড়িতে থাকতে এলেন। তিনি সাথে করে এনেছিলেন এক ঠোঙা খুদ। আমার মায়ের ভারী অভিমান হয়েছিল,” তুমি আমার মেয়েদের জন্য খুদ এনেছ!” দিদা খানিক সংকুচিত হয়ে বলেছিলেন, “ ওরা কোনদিন খুদ-ভাত খায় নি বললো, তাই… না হয় থাক…”। কিন্তু, আমি জেদ ধরলাম। পরেরদিন দিদা একটা মেটে হাঁড়িতে খুদ আলু আর আধমুঠো মুগডাল দিয়ে রান্না চড়ালেন। টুক টুক করে তাতে পড়লো স্বাদমতো নুন সামান্য নারকেল কোরা একচামচ ঘি… শীতের সকালে রান্নাঘরের মাটির দাওয়ায় বসে সে যে কী অসামান্য রান্না খেয়েছিলাম, তার তুলনা হয় না। এমন সব স্বাদু স্মৃতি মুহূর্তে মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার মাথায় বইটি পড়তে গিয়ে। দুইপাতা পড়েছি আর চোখ বুজিয়ে ভেবেছি এইসব… আমার সাধারণ জীবনের অতিসাধারণ কিছু রৌদ্রজ্বল দিনের কথা। রিপাবলিক স্কুলের কথা পড়তে গিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে আমার বাবার  ছোটবেলার “ বারুইপুর হাই স্কুল”। এই সেদিনই কথা হচ্ছিল, বাবার সাথে পড়াশুনা করা বন্ধুরা কেমন করে একে একে স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হতেন… শিবহরির সঙ্গে বাবার বন্ধু তফরকাকা এক সারিতে দাঁড়িয়ে আমাকে যেন একই গল্প শুনিয়ে গেলেন। 
ঝুলন সাজানোর কথা পড়ে খুব মনে পড়েছে টুম্পুরাণীর ছেলে বাবুদাদার কথা। স্কুলে ফার্স্ট হওয়া ছেলে বাবুদাদাকে টুম্পুরাণী কারো সাথে মিশতে দিতেন না। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণবশত: ঝুলনের দিন তাদের বাড়ির দরজা থাকতো সবার জন্য খোলা। আর বাবুদাদা এত সুন্দর ঝুলন সাজাতো যে আমরা ছোটরা দেখতেই থাকতাম…সবকিছু যেন জ্যান্ত,  সত্যি সত্যি পাহাড়,  নদীতে কলকলিয়ে জল ছুটেছে…সেই বাবুদাদা গ্রাজুয়েশনের সময় হুট করে আত্মহত্যা করে বসল… বাবুদাদার সেই ঝুলন সাজানো কতযুগ পরে চোখের সামনে ফুটে উঠল এই বইয়ের লেখা পড়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক ছোট্ট মফস্বল কেমন করে বদলে গেছিল, কেমন করে একটি ইস্কুল তার ছাত্রদের নিয়ে শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তা নিয়ে বড় সুন্দর ছবি এঁকেছেন লেখক। ভেদাভেদ ভুলে দুইদেশের মানুষ পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, এমন মরমী ঘটনা আজকের দিনে এই অশান্ত ক্ষয়িষ্ণু সময়ে মনে সাহস জোগায়।
আর ভালো লেগেছে নিষ্পাপ কিছু ভালোলাগার কথা, যাকে প্লেটোনিক প্রেম বলাই যায়… কী নরম করেই না তাদের নিয়ে লিখেছেন লেখক। এই ভালোলাগা যেন চিরকালীন বিষাদ হয়ে চরিত্রগুলির শরীরে জড়িয়ে রইল। প্রণবদার নীতাদিকে ভালো-লাগা, সেই নাম না জানা ছেলেটির ছন্দিতাকে ভালো-লাগা, দেবেশ্বরের আমীরাকে ভালো-লাগা…এদের সবার ভালো-লাগা যেন ভালোবাসা হয়ে ফুটে উঠেছে পথের ধারের ভাঁটফুলের মতো। এই ভালোবাসার কোনো দাবী নেই, সে শুধু নির্বিকারে ফুটে ওঠে, ঝরে যায়।
রূপেশ্বরী নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই স্মৃতিমেদুর বইটি আরো পাঠক-প্রিয় হোক। এই বইটির সাথে এমন নিভৃত টাইম-ট্রাভেল আমার বড়ো ভালো লেগেছে। বইটির প্রকাশক সুপ্রকাশ প্রকাশনী। এত সুন্দর একটি বই প্রকাশের জন্য তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
.........................
 
বই : আহাম্মকের খুদকুড়ো
লেখক : দুর্লভ সূত্রধর
মূল্য : ২৮০ টাকা
সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।