এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

 আমার জন্মের অনেক আগে, আনুমানিক ১৯৪৫ সালে আমাদের বাড়িতে একটা ভয়ঙ্কর ডাকাতি হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই সেই গল্প আমি বারবার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে শুনে আসছি কখনও মা, কখনও কাকিমা-জেঠিমা, কখনও বড়দি, কখনও বা গ্রামের কোনো বয়স্ক মানুষ সেই গল্পের কথক কথক অনুসারে সেই গল্পের রূপ কিছুটা বদলে বদলে গেলেও, মূল গল্পটা প্রায় একই ছিল সেটা নিয়ে আমি একটা গল্পও লিখেছি গল্পের নামমাছি ইংরেজ আমলের ডাকাতির গল্পেমাছিশব্দের একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে সেটা যারা জানেন তাঁরা জানেন, যারা জানেন না তাঁরা এই লেখার শেষে জেনে যাবেন  আমার লেখা-গল্পে মূল ঘটনার উপরে যথেষ্ট রঙ চড়িয়ে আমি মাছি শব্দটিকে নতুন দ্যোতনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু এখন লোকমুখে শোনা ঘটনাটিকে কেবল সাজিয়েগুছিয়ে সাদামাটা ভাবে বর্ণনা করব 

তবে তার আগে ইংরেজ আমলের ডাকাতির কথা একটু বলে নিই কেন ইংরেজ আমল? তার আগে কি ডাকাতি ছিল না? অবশ্যই ছিল কিন্তু তখন গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়া সমাজসিদ্ধ ছিল বলে সেটাকে ডাকাতি বলা যাবে না ডাকাতি ব্যাপারটা জনপ্রিয় হতে থাকে কোম্পানির আমল থেকে সেই জনপ্রিয়তার জোরে ডাকাত এবং ডাকাতি শব্দ দুটি ইংরাজি ভাষার শব্দভাণ্ডারে ঢুকে পড়ে এই ডাকাতি-কৃষ্টির লালনপালন করতেন জমিদাররাই বহু জমিদারই ডাকাতের দল পুষতেন কোম্পানির পুলিশ নেপথ্যের বোঝাপড়া অনুসারে কখনও এদের প্রশ্রয় দিত, কখনও আবার দমন করত ঠগি বা ঠ্যাঙ্গাড়েদের কথা সবাই জানেন, তারা এমনই নৃশংস ছিল যে পথিকদের প্রাণটুকুও কেড়ে নিত সেটা সহ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় স্লিম্যান সাহেব ঠগিদের নির্মম হাতে দমন করেন

এসব নেহাতই ইতিহাসের কেজো কথা এর বাইরে ডাকাতদলের কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমানসে একটা রোমান্টিক ধারণা গড়ে ওঠে ডাকাতদলের কালীভক্তি, নীতি ও শৃঙ্খলা মেনে চলা, খুন এবং মেয়েদের শরীর স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা এবং আগাম চিঠি দিয়ে ডাকাতি করতে আসা ইত্যাদি ছিল সেই রোমান্টিক অনুষঙ্গ সেই সঙ্গে কিছু কিছু ডাকাত সর্দারের মহত্ত্ব কিংবদন্তীর মর্যাদা পেয়ে যায় সাহিত্যের একটা বড়ো উপাদানও হয়ে ওঠে ডাকাতির গল্প ইংরাজি লোককথা রবিন হুডের আদলে বাংলা সাহিত্যেও রঘু ডাকাত, বিশু ডাকাত ইত্যাদিদের নিয়ে গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখা হয় তাছাড়া সশস্ত্র স্বাধীনতা-সংগ্রামীরাও কখনও কখনও অর্থের প্রয়োজনে ডাকাতি করতেন এই ব্যাপারটা জনসাধারণের চোখে ডাকাতিকে একটা বাড়তি মর্যাদা দেয়  

তো আমাদের বাড়িতে যখন ডাকাতি হয়, তখন ডাকাতদলের রমরমা অনেক কমে গেলেও গ্রামাঞ্চলে অবস্থাপন্নদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই তাদের আগমন ঘটত তার একটা বিশেষ কারণ এই যে তখন দেশে ব্যাঙ্কিং ব্যাবসা চালু হলেও এতো ঘন ঘন তাতে লালবাতি জ্বলত যে মানুষের মনে তার বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়নি ফলে সঞ্চয় করার সাধ্য এবং ইচ্ছে যাদের ছিল, তারা টাকাপয়সা মোহর কিংবা রুপোর টাকায় রূপান্তরিত করে পিতল বা কাঁসার পাত্রে ভরে তার মুখ বন্ধ করে বাড়ি বা বাখুলের কোনো গোপন স্থানে পুঁতে রাখত সেসব অন্ধিসন্ধির সন্ধান ডাকাতদল চর মারফত জোগাড় করার চেষ্টা করত, বাকিটা ডাকাতি করার সময় বাড়ির লোককে মারধোর করে, ভয় দেখিয়ে জেনে নিত কখনও সফল হতো, কখনও হতো না তবে বাড়ির মেয়েদের গয়না যেহেতু তাদের গায়ে বা বাক্স-প্যাঁটরার মধ্যে থাকত, সেগুলো সহজেই তাদের হস্তগত হতো

আমাদের বাড়িতেও যে লুকনো টাকাপয়সা থাকে সে-খবর গোপন ছিল না ডাকাতদলের কাছে তবে অসুবিধে ছিল একটাই আমাদের বাড়িতে একটা বন্দুকও ছিল যে-সে বন্দুক নয়, মেড ইন জার্মানি দোনলা বন্দুক অতএব এমন একটা সময় বাছতে হবে যখন বন্দুক চালানোর মতো লোকের অভাব হবে বাড়িতে আমার দাদুর তিন ছেলে বড় ছেলে যুবাকালেই বজ্রাঘাতে মারা গেছেন সেই শোকে শয্যা নিয়েছিলেন দাদু বেশিদিন গেল না, তিনিও পরলোকে গেলেন বাড়িতে সমর্থ পুরুষ বলতে বাবা আর কাকু দুজনেই তখন চল্লিশের প্রথম ধাপে, পরিণত যুবক বলা চলে কৈশোর পেরোনো আমার দুই দাদাকেও প্রায়-সমর্থ ধরা চলে একজন আমার বাবার বড়ো ছেলে, চাঁদ অন্যজন আমার মৃত জ্যাঠামশায়ের একমাত্র ছেলে, পচাই বাকি সব ছেলেমেয়েরা তখন শৈশব বা বাল্য অবস্থায়

দাদু মারা যেতে বাবা কাকু দুজনেই মহাশৌচ পালন করার সিদ্ধান্ত নেন মহাশৌচের মানে হলো পুরো একটি বছর অশৌচ পালন করা বন্দুক না ধরাও এই পালনের অন্তর্গত কারণ, বন্দুক অশুচি, তাতে চামড়া লাগানো থাকে চাঁদ অবশ্য সাহসী এবং বন্দুকটাও সে ভালই চালাতে পারে অতএব ডাকাতরা এমন একটা দিন বাছল যে-রাতে চাঁদ বাড়িতে অনুপস্থিত সে জঙ্গল ব্যাবসায় নেমেছে, প্রায়ই তাকে বাইরে থাকতে হয় মহাশৌচ আর কদিন পরেই শেষ হবে তারপরেই সম্বচ্ছরের শ্রাদ্ধ তার খরচের জন্যে ধান বিক্রি করে নগদ টাকাপয়সাও মজুত আছে কাঠের আলমারিতে সে-খবরও ছিল নিশ্চয় ডাকাতদের কাছে  

ঠিক মাঝ রাতে ডাকাতরা ঢুকে পড়ল বাড়িতে আমাদের কাঁচা-পাকা দোতলা বাড়ি প্রথমে সদর দরজা ভেঙ্গে বাখুলে ঢুকল ডাকাতরা মানভুমের ডাকাতদল, লম্বাচওড়া চেহারা, মুখে পুরুষ্টু মোছ পরনে মালকোঁচা মেরে পরা আটহাতি ধুতি, তেলমাখা খালি গা, হাতে জ্বলন্ত মশাল

দোতলার মাঝের ঘরে জেঠিমা আর পচাই, পুব দিকের ঘরে মেঝেতে কম্বলের বিছানায় শুয়ে পালনে থাকা বাবা-কাকু দুই ভাই দোতলার পশ্চিম দিকের ঘরটির সঙ্গে মাঝের ঘর বা পুবের ঘরের সরাসরি কোনো যোগ নেই সেই ঘরে ওঠার কোনো পাকাপোক্ত সিঁড়িও নেই সেটি এক দুর্গ-বিশেষ ঘরের মাঝখানে দেওয়াল ঘেঁসে একটি মেঝেতে একটি চৌকো ফুটো আছে সেই মাপের একটি চৌকো তক্তা দিয়ে সেটি ঢাকা থাকে সেটিই হলো ঘরের দরজা একতলার দেওয়ালে মই লাগিয়ে উঠে হাত দিয়ে তক্তাটি ঠেলে সরিয়ে উপরে উঠতে হয় নামার সময়ও একইভাবে দরজায় পা ঝুলিয়ে মইয়ের ধাপে পা দিয়ে নেমে আসতে হয় এই উঠানামা খুব সহজ ব্যাপার নয় তবে অনেক দিন ধরে ওঠানামা করতে করতে বাড়ির সকলের কাছে তেমন কঠিন বলে মনে হয় না বাড়িতে ডাকাত পড়লে খানিকটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে সে-আমলে প্রতিটি অবস্থাপন্ন গৃহস্থই এমন একটা দুর্গের মতো ঘর করে রাখতেন

নীচতলার পুব দিকের ঘরে কাকিমা আর পশ্চিম দিকের ঘরে মা যে-যার ছানাপোনা নিয়ে শুয়েছিলেন সদর দরজা ভাঙ্গার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেতেই মা তাঁর দুই মেয়ে আর দুই ছেলেকে নিয়ে দোতলার দুর্গ-ঘরে উঠে গেলেন তাঁর পিছন পিছন কাকিমাও উঠলেন তাঁর এক ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে যে-মই বেয়ে উঠলেন সেটিও উপরে তুলে নিয়ে সেই চৌকো কাঠের তক্তা চাপা দিয়ে মেঝের দরজা বন্ধ করলেন তারপর উপরে যত ভারী জিনিস ছিল সব সেই তক্তার উপর চাপালেন যাতে নীচ থেকে ডাকাতরা সেটা সহজে ঠেলে সরাতে না পারে আমার অসমসাহসী ঠাকুমা সকলের বাক্সপ্যাঁটরা আগলে একাই রইলেন নীচতলার মাঝের ঘরে 

কাকিমা তখন পূর্ণগর্ভা যেকোনো দিন প্রসব বেদনা উঠতে পারে মায়ের কোলেও একটি এক বছরের ছেলে, তবে তাঁর বড়ো মেয়ে সরযূর বিয়ে হয়ে গেছে দ্বিরাগমন হয়নি বলে এখনও মায়ের কাছে তাঁর গায়ে সোনা রাখতেই হবে বলে ভারী মাকড়ি দুটি কানে ঝুলছে বাকি সব গায়ের গয়না খুলে পুঁটলি করে পেটকাপড়ে লুকিয়ে নিয়েছেন মা কাকিমা দুজনেই

সদর দরজা ভাঙ্গা হতেই তিনজন ডাকাত হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে বাখুলের তিন দিকে দাঁড়িয়ে পড়ল পাহারায় বাকিরা দুটি দলে ভাগ হয়ে একদল ঘরের পশ্চিম দিকের দরজার কাছে দাঁড়াল দরজা ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিয়ে অন্য দল হামারচালার পাশ দিয়ে পুব দিকের রান্নাঘর আর উঠোনের মাঝে দোতলায় ওঠার পাকা সিঁড়ির নীচে দাঁড়াল সিঁড়িটি বাইরের উঠোন থেকে দোতলায় উঠেছে সিঁড়ি শেষে দোতলার শক্তপোক্ত লোহার বোতাম লাগানো ভারী কাঠের দরজা

প্রথম দল সহজেই পশ্চিমের দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ল একতলায় একতলা প্রায় ফাঁকা একজনই মাত্র শক্তপোক্ত বুড়ি কিন্তু অপূর্ব সুন্দরী, একটি লণ্ঠন জ্বেলে মেঝের উপর পিঁড়ি পেতে বসে আছে তাকে গ্রাহ্যি না করে এক ডাকাত সব কটা ঘরের আনাচ কানাচ থেকে বাক্সপ্যাঁটরা খুঁজে বের করে এনে মাঝের ঘরের মেঝেয় ঝনঝন করে ফেলতে লাগল আর অন্য ডাকাত সেগুলো খাটো শাবলে চাড় দিয়ে দিয়ে ভাঙতে লাগল সেই বুড়ি মানে আমার ঠাকুমা ভাঙা বাক্সের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ছোট ছোট কৌটো আর কাপড়ের থলির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন বাজে জিনিস রাখা থলি বা কৌটো ডাকাতরা তাদের চটের থলেতে ভরার উপক্রম করলেই বলে উঠছিলেন, ওরে উল্লুক, উটায় দামি কিছু নাই, সংসারের হেঁজিপেঁজি জিনিস আছে ঠাকুমার সত্যি কথা মিথ্যা বলে ধরে নিচ্ছিল ডাকাতরা এই কৌশলে তাদেরকে বোকা বানিয়ে তিনি নাকি দু-চারটে দামি জিনিস বাঁচাতে পেরেছিলেন

দোতলার পুব দিকের ভারী দরজা ডাকাতরা যখন শাবল দিয়ে ভাঙতে শুরু করেছে, তখন বাবা আর কাকু উঠে কম্বলের উপর বসে আছেন বাবা পচাইকে বললেন, টোটা ভরে বন্দুকটা লিয়ে তুমি দরজার কাছে দাঁড়াও কপাট ভাঙলেই উপর দিকে গুলি চালাবে ভয় দেখাতে, আবার ওদের গায়ের উপরে চালাই দিও না যেন

পচাই বন্দুক নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কপাট যখন ভাঙ্গল, পচাই গুলি চালাবে কি, বন্দুক হাতে থরথর করে কাঁপছে এক ডাকাত লাফ দিয়ে এসে এক ঝটকায় তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিল সঙ্গে সঙ্গেই তিন ডাকাত ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে

ওদিকে একতলার ডাকাতরা নীচের ঘরের তল্লাসি সেরে দোতলার পশ্চিম দিকের ঘরে ওঠার তোড়জোড় করতে লাগল তারা দোতলার মেঝেতে বসানো তক্তার কপাট ঠেলে ওঠার চেষ্টা না করে পশ্চিমের দেওয়ালে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসা মই ঠেকিয়ে উপরের ঘরের একমাত্র জানালার কপাট ভেঙে, শিক কেটে উঠে পড়ল দোতলায় মা আর কাকিমা পেটকাপড়ে নিজেদের গায়ের গয়না লুকিয়ে ছেলেমেয়ে আগলে নিয়ে বসে বসে কাঁপছিলেন সরযূ একটা দড়ির খাটিয়ার নীচে লেপের তলায় লুকিয়ে ছিল ডাকাতগুলো মা-কাকিমার গায়ে হাত দিল না কিন্তু দড়ির খাট উল্টে ফেলে লেপ সরিয়ে সরযূকে আবিষ্কার করে ফেলল তার কানের মাকড়ি ধরে এমন টান দিল যে কানের লতি ছিঁড়ে মাকড়ি তাদের হাতে চলে গেল সে ভয় আর যন্ত্রণার চোটে অজ্ঞানই হয়ে গেল তার কান থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে দেখে মা-কাকিমা, সঙ্গে ছেলেমেয়ের ভয়ার্ত কান্নার রোল ছড়িয়ে পড়ল গাঁ-ময়

দোতলার পুব দিকের ঘরে তখন অন্য এক দৃশ্য পাশাপাশি বসে ছিলেন দুই ভাই বাবাকে গ্রাহ্য না করে দুজন ডাকাত কাকুকে ঘিরে ধরল অন্য জন সোজা কাঠের আলমারির কাছে গিয়ে সেটার তালা ভেঙে ফেলল সম্বচ্ছরি শ্রাদ্ধের নগদ টাকা যা ছিল সবই তাদের থলেতে ভরল কাকুর ডান হাত ধরেছে এক ডাকাত, বাঁ হাত ধরেছে অন্য ডাকাত হাতে হ্যাঁচকা টান মেরে ডানের ডাকাত বলল, ভালো মানুষটার মতন বল্যে দাও দেখি হে চাঁদি-মোহর কুথায় কুথায় লুকানো আছে?

অন্য হাতে হ্যাঁচকা টান মেরে বাঁয়ের ডাকাত বলল, গুমসাই বস্যে থাইকো না ছুটো কত্তা তুমার মা যে তুমার কানে সব হদিশ দিয়ে রাখ্যেছে তার পাক্কা খবর আছে বুঢ়ি মাইয়ের গায়ে হাত দেওয়া মা-কালীর বারণ তাই তুমাকেই হাটকাই বাইর করতে হবেক

কাকু তো ভীষণ তোতলা, তার উপরে আতঙ্কে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন কিছু একটা বলার চেষ্টায় তাঁর চোখমুখ লাল হয়ে গেছে কিন্তু--ছাড়া কোনো কথা বেরোচ্ছে না তাঁর মুখ দিয়ে ডানের ডাকাত এবার তাঁর হাত মুচড়ে বলল, চুপ মাইরে থাক্যেছ কি দু-টুকরা কর্যে খালের জলে ভাসাই দিয়ে যাব

বলেই সে কেড়ে নেওয়া বন্দুকের বাট সজোরে বসিয়ে দিল কাকুর পিঠে বাবা বলে উঠলেন, মেরো না ওকে, ও খুব তোতলা, তাই কথা বলতে পারছে না

--চুপ রাহ্‌ – বলেই সে এবার বাবার মাথায় সজোরে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করল তাঁর মাথা ফেটে রক্ত গড়াতে লাগল 

ঘরের ভিতরে এইসব যখন ঘটে চলেছে তখন বাইরেও কিছু ঘটছিল কপাট ভাঙ্গার বিকট আওয়াজের সঙ্গে আর্ত চিৎকার এবং কান্নার রোল সারা গাঁয়ের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল সে-যুগে একজনের বাড়িতে ডাকাত পড়লে গ্রামের লোক নিজেদের বাড়ির দরজা এঁটে বসে থাকত না সেদিন সেই সময় গাঁয়ের জোয়ান-মদ্দরা আমাদের বাড়ির সামনের দিকে মাঠে জড়ো হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল সাড়ে চার ফুট মাত্র লম্বা কিন্তু অসমসাহসী নীলমণি গোসাঁই সে কাঁড়(তির) চালানোয় ওস্তাদ গাঁয়ের ছেলেদের কাঁড় চালানোর শিক্ষাও দিত সে সেদিন তার সঙ্গে তার কয়েকজন শিষ্যও কাঁড় আর কাঁড়বাঁশ(ধনুক)নিয়ে হাজির হয়েছিল নীলমণি ইশারা করা মাত্র তারা কুলকুলি(খোলা মুখে হাত দিয়ে চাপড় মারতে মারতে আওয়াজ করা)দিয়ে উঠেই আমাদের বাড়ি লক্ষ্য করে কাঁড় ছুঁড়তে শুরু করল পুব দিকের সিঁড়িতে মশাল হাতে পাহারায় থাকা ডাকাত-সর্দারকে সচকিত করে অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা কাঁড় সাঁই শব্দে তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে এসে দোতলার ভাঙা কপাটে বিঁধে থিরথির করে কাঁপতে লাগল সর্দার সজোরে একটা শিষ দিয়েমাছি মাছিবলে চেঁচিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গেই সব ডাকাতগুলো সর্দারের পিছনে এসে জড়ো হলো লুকনো গুপ্তধনের সন্ধান ছোট কত্তার কাছ থেকে বের করার আর সময় নেই বুঝে সেই ডাকাত দুটো কাকুর হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে এসে বাড়ির পিছনের কুল গাছের তলায় এনে ফেলল তাঁর ধুতি ছিঁড়ে সিঁড়িতে ঝুলছে, উলঙ্গ শরীরের চামড়া ছড়ে গিয়ে রক্তে লাল হয়ে উঠেছে

আর বিন্দুমাত্র দেরি করার ঝুঁকি না নিয়ে মশাল নিভিয়ে অন্ধকারের মধ্যে শূন্যে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ির পিছন দিকের রাস্তা ধরে চম্পট দিল ডাকাতের দল

টাকাপয়সা, সোনাদানা বেশ কিছু লুট করে নিয়ে গেলেও, বাবা, কাকু বা বড়দি, সরযূবালার আঘাত তেমন মারাত্মক হয়ে ওঠেনি পরদিন ভোরবেলাতেই লোক মারফত খবর পেয়ে পাঁচ মাইল দূরের নদী পারের গ্রাম থেকে ঘোড়ায় চেপে এলেন মিহির ডাক্তার বাঁকুড়া জেলার সিমলাপাল আর মেদিনীপুর জেলার গড়বেতার মধ্যিখানের বিশাল অঞ্চলে তখন তিনিই একমাত্র এম বি পাশ করা তরুণ ডাক্তার তিনি আবার আমাদের মিহির দাদা কারণ, আমার ছোট পিসির মেয়ে তীর্থবালা ছেলেবেলায় মাতৃহীন হয়ে আমাদের বাড়িতেই মানুষ হয় তার সঙ্গে মেধাবী ছাত্র মিহিরের বিয়ে দেন আমার দাদু কাজেই তিনি আমাদের বাড়ির খুব সম্ভ্রম ও আদরের জামাই মিহির দাদা এসে বাবার মাথার চামড়ায় আর সরযূর কানের লতিতে সেলাই দিয়ে আর কাকুর কাটাছেঁড়ায় ওষুধ দিয়ে তাদের সহজেই সারিয়ে তুলেছিলেন

কথার টানে লিখে ফেললেও ডাকাতির গল্পে এসব কথা নেহাতই অবান্তর আসল কথা মাছি সে-আমলের বন্দুকওলা ডাকাতদলের কাছেও অন্ধকার রাতে কাঁড়ের শনশন আওয়াজ যে মাছির ভনভনানির চাইতে কম অস্বস্তির, কম বিরক্তির ছিল না, এই পরোক্ষ স্মৃতিকথায় সেটিই সবিশেষ এক গূঢ় বৃত্তান্ত 

.......................................

এক যে ছিল গ্রাম

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

.......................................


প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত


মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা

সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।