আহাম্মকের খুদকুড়ো।। দুর্লভ সূত্রধর।।

'মায়ের হাঁড়িতে কখনও ভাতের অভাব হতো না। যদি-বা কখনও হতো তা আমরা টের পেতাম না—তার চোটটা হয়তো মায়ের পাতের ওপর দিয়েই যেত! মায়ের হাতে টাকা জমলেই মা চাল কিনে রাখতেন। রীতিমতো মুটে নিয়ে আসত বিরাট চালের বস্তা—আড়াই মণ—একশো কেজি বা এক কুইন্টাল চাল ৷ একটা বড়ো কালো ড্রামে (তদানীন্তনকালের কেরোসিন তেলের ড্রাম) তা ভর্তি করা হতো। তাতে না ধরলে বড়ো বড়ো হাঁড়িতে চাল রাখা হতো। এইভাবে যথেষ্ট পরিমাণে গমও মজুত থাকত। চাল ফুরোবার আগেই আবার নতুন চাল কেনা হতো। সস্তার সময়ে কয়েক বস্তা আলু কিনে রাখতেন মা। চৌকির তলায় সাদা বালির আস্তরণের ওপর আলু বিছিয়ে ছিল মায়ের নিজস্ব হিমঘর !

মজুতের প্রক্রিয়াটা শুনতে যতটা সহজ, কাজে ততটাই কঠিন ছিল। চাল বা গমে পোকা লেগে যেত বলে নিম পাতা বা পরতে পরতে চুন ছড়িয়ে রাখা হতো এবং নিয়মিত তদারকি করতে হতো। আর প্রত্যেকদিন চৌকির তলায় ঢুকে আলুগুলোকে উল্টে পাল্টে দিতে হতো, বেছে বেছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল আলুগুলোকে সেদিনের রান্নার জন্য বের করতে হতো। মায়ের এসব উদ্যোগে দিদিদের কঠোর শ্রম করতে হতো। মায়ের কাছ থেকেই স্থৈর্য পেয়েছিল আমাদের দয়াবতী দিদিরা— আমার মতো আকাটরা তাই তরে যেতে পেরেছিল।

এত হ্যাপা পুইয়েও বাবার প্রণোদনায় মা চাল-গম-আলু ঘরে রাখতেন —যেন এতগুলি সন্তানের দুধ-ভাত না হলেও, শুধু ভাতের জোগাড়টুকু অন্তত থাকে।

ভারতচন্দ্রের অন্নপূর্ণা ভবানন্দকে অতুল ঐশ্বর্য দিয়েছিলেন।

কিন্তু আমাদের অন্নপূর্ণা মায়ের আত্যন্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও অন্তত একদা দু-বেলা দু-থালা ভাতের গল্পটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। বিগত শতকের ষাটের দশকের মধ্যান্তিক সময়ে আমাদের সমগ্র রাজ্যেই তীব্র খাদ্য-সংকট দেখা দেয়। চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, তারও চেয়ে বড়ো কথা— পয়সা থাকলেও চাল ছিল অমিল। উৎপাদন হ্রাস, সরকারি স্তরে ধান সংগ্রহ, চাল বন্টন ব্যবস্থার বিপর্যয়, লেভি-কর্ডন, আন্তঃজেলা চাল-চলাচলে বাধা, কালোবাজারিদের দাপট সমাজজীবনকে একেবারে দিশেহারা করে দেয়। চাল পাওয়া যায় না, গম পাওয়া যায় না খোলাবাজারে— চারিদিকে নেই নেই ভাব। সহসা একটা ভয় সব গৃহস্থকে গ্রাস করল যেন। চাল পাওয়া না যাওয়ায় আমাদের মতো পরিবারগুলিতে দু-বেলা ভাত খাওয়া তো দূরের কথা এক বেলা ভাত জোগানোও কঠিন হয়ে পড়ে। এমন কী গমও অমিল হলো। বিদেশী সাহায্যবাবদ পাওয়া যেতো গমের বদলে ভুট্টা ও মাইলো।

কোথাও মাথাপিছু এক-দু কেজি চাল দেওয়া হবে শুনলে আমাদেরও পড়াশুনো ফেলে থলি হাতে দৌড়তে হতো। আমাদের মতো পরিবারে রেশনের অখাদ্য চালের ভাতই হোক কিংবা খুদের ফেনা ভাতই হোক একবেলা ভাত জুটত, কিন্তু আরও নিম্নআয়ের পরিবারগুলিতে অর্ধাহার ও অনাহার ঘনিয়ে এসেছিল। এই সংকটকালে রাজ্যজুড়ে, এই শহরেও স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল।

সে অবশ্য এক স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ।

ভুট্টা আর মাইলো। দুটো জিনিসই অবুঝ ছোটোদের কাছে ‘অখাদ্য’ বলে প্রতিভাত হয়েছিল।

রেশনের গন্ধযুক্ত চালও খাওয়ার অযোগ্য ছিল।

কিন্তু পেটের জ্বালা বড়ো জ্বালা!

সেই চাল-আটাই গলাধঃকরণ করতে হতো। ভুট্টার রুটির চারপাশটা ফেটে ফেটে যেত। গরম গরম ছাড়া সে রুটি খাওয়ার সাধ্য আমাদের ছিল না। আমরা উনোনের পাশে উটকো হয়ে বসে থাকতাম, উনোনের আগুন থেকে রুটি নামলেই আমরা তা সরষের তেল নুন ডলে খেয়ে নিতাম। 

—জানিস, ভারতবর্ষে কত লোকের সারা বছর ভুট্টার রুটিও জোটে না।' গেরেম্ভারি চালে বলত মেজদি।

হাসিমুখে ভুট্টার রুটি খেলেও অবশ্য মাইলো ব্যাপারটা সর্বংসহা মেজদিও সহ্য করতে পারতো না।

এই সময় একবেলা ভাত পাওয়া যেত এবং তা ফ্যানসুদ্ধু। আর হতো খুদের ফ্যানাভাত। নুন-তেল দিয়ে তা খেতে হতো। সঙ্গে প্রতিদিন আলুসেদ্ধ জোটাও মুশকিল হতো। এসব নিয়েই আমাদের ছোটোদের অসন্তোষ ছিল—মায়ের বিপন্নতা, কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজ বা উদ্বেগাকুল আনন-লিপি পাঠ করার মতো বয়স বা বুদ্ধি ছিল না আমাদের।

অন্নাভাবকে মা ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছিলেন খাবারের পরিমাণে শৃঙ্খলা এনে, বিকল্প খাবারের আয়োজন করে, বন্টনে সতর্কতা অবলম্বন করে। সেই বিপন্নতার মধ্যেও মায়ের দুয়ার থেকে কেউ দু-মুঠো না পেয়ে ফিরে যাননি।

সংসারের কোনোদিকে নজর না থাকলেও পাতে ভাত নষ্ট করলে বা খাবার সময় এক-দানা ভাত মাটিতে পড়লে বাবা ভীষণ চটে যেতেন—চাল যে লক্ষ্মী! ক্ষুধার অন্ন যে লক্ষ্মীর দান! প্রতিটি দানা ফলাতে কৃষককে কত কষ্ট করতে হয়—তাকে অবহেলা! মা প্রাণপণে লক্ষ্মীকে আগলে রাখতেন স্বামী-সন্তানদের জন্য, অন্যান্য সামাজিকদের জন্যও।

এসবের মহিমা সেদিন বুঝিনি।

এখন কেউ কারো বাড়িতে নিজের অধিকারে 'দিদি' বলে ডেকে আতিথ্য নেয় না, মেগে খাওয়া অন্নের দাবিদারের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। এখন কোনো ঘনিষ্ঠ বা আপনার জনের বাড়িতে খবর না দিয়ে অসময়ে গিয়ে পড়লে তাদের বিরক্তি ব্যতিরেকে পাত-পাড়া মুশকিল — হয়তো অসম্ভবও!

হয়তো একেই বলে কালের গতিক—এখন সম্পর্কের সময় কম, সুখ-দুঃখ বিনিময়ের অবকাশ নেই। এখন নদী-মাঠ-ডোবায় কলমি শাকের ফুলগুলো হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে মাসিদের ডাকে না, গরমকালের দুপুরে আকাশনিম গাছে ঝুপ্পুর পাতার আড়ালে বসে হা-ক্লান্ত খয়রাপাখ পাপিয়া আর গরমের ছুটিটাকে ভরিয়ে দিতে আসে না। পাখিগুলো এখনও টিকে আছে কী-না তারই বা ঠিক কি, গরমের ছুটির মতো সেগুলোও হয়তো বিলুপ্ত হয়েছে! পুরোনোকালের সেই কষ্টের বোধটাই তো আজ উধাও।

আহাম্মকটা ভাবে, হবেও বা। সে দুঃখ-দুঃখু মুখ করে ভাবে—মায়েদের অনন্ত পরমায়ু পাওয়া দরকার—আমাদের সেদিনের বয়সটা আর আজকের সক্ষমতাটুকু একসঙ্গে থাকলে কত যে ভালো হতো!'
.
.
.
.
আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : দুর্লভ সূত্রধর

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।