বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

‘হালুইকর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আসলে কী?
সংসদ বাংলা অভিধান জানাচ্ছে—‘মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক, ময়রা।’১
১৯৫৭ সালে সাহিত্য সংসদ-প্রকাশিত এবং শৈলেন্দ্র বিশ্বাস-সংকলিত এই অভিধানে দেওয়া এ শব্দটির এহেন সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের ব্যাপারে মতৈক্য দেখতে পাচ্ছি কাজী আব্দুল ওদুদের ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’ (প্রথম প্রকাশ, ১৯৫৩)২ এবং ড. মুহম্মদ এনামুল হক ও শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী-কৃত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ (প্রথম প্রকাশ, ১৯৭৪)৩।
১৯১৭ সালে ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে প্রকাশিত জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ ‘হালুইকর’-এর অর্থ লেখা হয়েছে—‘যে হালুয়া—তাহা হইতে মিষ্টান্ন প্রস্তুত করে।’৪ প্রায় একইরকম প্রতিধ্বনি ঘটেছে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এও (প্রকাশকাল, ১৩৪০-১৩৫৩ বঙ্গাব্দ)—‘যে হালুয়া করে, মিঠাইকার, ময়রা।’৫ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ‘হালুইকার’ বানান ব্যবহার করেছেন, তা নিশ্চিতভাবেই উচ্চারণ-ভিন্নতা থেকে উদ্ভূত।
আরও একটু বিস্তৃত বিবরণ পাচ্ছি সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’ (প্রথম প্রকাশ, ১৯০৬) এবং রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা অভিধান’-এ (প্রথম প্রকাশ, ১৯৩০)। প্রথম অভিধানে হালুইকর সম্পর্কে লেখা হয়েছে—‘মিষ্টান্নাদি নির্মাতা, যে ব্যক্তি লুচি মিষ্টান্ন প্রভৃতি প্রস্তুত করে ; মোদক জাতি।’৬ ‘চলন্তিকা’-য় সে ব্যাখ্যা এরকম—‘ময়দা দাল ইঃর (ইত্যাদির) মিষ্টান্ন বা জলখাবার যে তৈয়ার করে, ময়রা।’৭
লক্ষণীয়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এবং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিকে জোর দিয়েছেন, সুবলচন্দ্র মিত্র বা রাজশেখর বসু সেখানে এই পেশার মানুষদের কাজ সম্পর্কে একটা সার্বিক চিত্র তুলে ধরেছেন। একই পথে হেঁটেছেন ‘বাঙ্গালা শব্দকোষ’-প্রণেতা যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধিও। লুচি রান্না করার কথা তাঁর অভিধানেও রয়েছে।৮ নির্দিষ্ট পেশার এসব মানুষদের অনেকেরই পদবি পরে হয়েছে হালুই বা হাউল্যা।৯
উনিশ শতকের শেষে স্বামী বিবেকানন্দ যখন ভারতভ্রমণ করছেন, সেই সময়ে একবার যুক্তপ্রদেশের (আজকের উত্তরপ্রদেশ) তাড়িঘাট স্টেশনে কপর্দকশূন্য অবস্থায় নেমে যখন খিদে-তেষ্টায় কাতর, সে সময়ে এক দোকানদার খাবার আর জল নিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন এইভাবে —‘কাছেই আমার এক পুরি-মেঠাইয়ের দোকান। আমি একজন হালুইকর।’১০ সেই হালুইকর নাকি দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর দিবানিদ্রা দেওয়ার সময়ে স্বপ্নে এক সন্ন্যাসীকে দেখেন, যিনি কিনা আসলে স্বামীজীর অবস্থার কথা জানিয়ে হালুইকরকে তাঁর যথোপযুক্ত সেবা করার নির্দেশ দেন।১১ স্বপ্ন দেখার ঘটনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়, কিন্তু অনাহারক্লিষ্ট বিবেকানন্দকে খাবার-জল দেওয়ার ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিল বলে যদি ধরে নিই, সেক্ষেত্রে তাড়িঘাট স্টেশনের সেই নাম-না-জানা হালুইকর মানুষটি নিজের অজান্তেই ইতিহাসের পাতায় এক মহত্তর আসনের অধিকারী হয়েছেন।
মিষ্টি-প্রস্তুতকারক এই পেশার মানুষরা অনেকেই নিজস্ব দোকান খুলতেন, দোকানের নাম নয়, তাঁদের নিজেদের নামেই জনমানসে পরিচিত হয়ে থাকতেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন স্বভাব-শিল্পী, যাঁরা মেতে উঠতেন নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষায়। বাঙালির রসনাতৃপ্তিতে হরেকরকম মিষ্টির এই যে ব্যবহার, এবং সমগ্র ভারতের মধ্যে এই মিষ্টি-বৈচিত্র্যের অধিকারী হয়েছে যে কেবল বঙ্গদেশ, এমন অর্জনের নেপথ্যে বাংলার এই ময়রা-মোদক-হালুইকরদের অবদান ঐতিহাসিক গুরুত্ব সহকারে বিচার্য।
মিষ্টি-নির্মাণের প্রসিদ্ধির কারণেই এঁরা একদিন ডাক পেতেন যজ্ঞিবাড়িতে, ভিয়েনের কাজে। মিষ্টি বানানোর মাধ্যমে সে ভিয়েন শুরু হয়ে যেত অনুষ্ঠান শুরুর দু-একদিন আগে থেকেই। সঙ্গত কারণও ছিল অবশ্য। সাবেক যৌথ পরিবারের সামাজিক অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট দিনের দিনকয়েক আগে থেকেই নিকটাত্মীয়দের আসা-যাওয়া শুরু হওয়ার চিরাচরিত প্রথা আজকের আণবিক পরিবারতন্ত্রেও দিব্যি বর্তমান। এই অতিথিদের জন্যই আগে থেকে শুরু করতে হতো  মিষ্টি তৈরি। অমানুষিক পরিশ্রমের সে যুগে টাটকা খাবারের প্রতি মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের ছিল এক স্বভাব-আসক্তি (কখনও কখনও অবশ্য, এর সঙ্গে জুড়ে থাকত দেখনদারি, রেষারেষিও)। মিষ্টি তৈরি হলে জনৈক বিশেষজ্ঞকে দিয়ে তা চাখিয়ে নিতেন বাড়ির কর্তা। নরম পাক ভালো লাগছে নাকি কড়া পাক, সে বিষয়ে ওই বিশেষজ্ঞের মতামতই শিরোধার্য। চাখার জন্য অবশ্য উঁকি-ঝুঁকি মেরে যেত বাড়ির ছোটোরাও, কিন্তু তাদের জন্য ‘ট্রেসপাসার্স উইল বি প্রসিকিউটেড’-এর নিদান। ফুটন্ত কড়া থেকে তুলে সাজিয়ে দেওয়া গরম সন্দেশ, পান্তুয়া, বা দরবেশের স্বাদ কেমন  হতো , তার বর্ণনা দিতে গিয়ে অস্তগামী বা প্রবীণ প্রজন্মের মানুষজনের চোখে যে স্মৃতিমেদুরতা প্রত্যক্ষ করেছি, সে মুহূর্তে তা হয়ে উঠেছে অতীতের জানলা।
জীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে, আপনভোলা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণেও তো উঠে এসেছিল তেমন এক ভিয়েনঘরের কথা—‘একদিন খেতে খেতে বললুম, কী সন্দেশ খাওয়াচ্ছেন নাটোর (নাটোরের তৎকালীন মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ, তাঁকে শুধু ‘নাটোর’ বলেই সম্বোধন করার রেওয়াজ ছিল), টেবিলে আনতে আনতে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। গরম গরম সন্দেশ খাওয়ান দেখি। বেশ গরম গরম চায়ের সঙ্গে গরম গরম সন্দেশ খাওয়া যাবে। শুনে টেবিলসুদ্ধ সবার হো-হো করে হাসি। তক্ষুনি হুকুম হলো, খাবার ঘরের দরজার সামনেই হালুইকর বসে গেল। গরম গরম সন্দেশ তৈরি করে দেবে ঠিক খাবার সময়ে।’১২
যদিও, গরম সন্দেশ খাওয়ার শখ আর সেদিন মেটেনি অবন ঠাকুরের। সেদিনই জাতীয় কংগ্রেসের প্রভিন্সিয়াল কনফারেন্সে বক্তৃতার ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-সহ আরও বহু যুবসদস্যদের সঙ্গে প্রবীণ, ইংরেজি-প্রেমী নেতাদের প্রবল বাকবিতণ্ডা হয়েছিল, আবার সভাভঙ্গের পরই হয় জোরালো ভূমিকম্প। নাটোর শহর জুড়ে এই ভূমিকম্পে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়, রক্ষা পায়নি রাজবাড়ি-চত্বরও, তার মধ্যে আর সন্দেশের কথা ভাবতে পারেননি কেউ।১৩
সন্দেশ ছাড়া সে যুগের ভিয়েনঘরে তৈরি হতো  পান্তুয়া আর বোঁদে। চওড়া কাঠের বারকোশে রাখা সেসব মিষ্টি থেকে রস গড়িয়ে পড়ত নিচে। তবে, যে বিশেষ শ্বেত মিষ্টি নিয়ে বাঙালির নস্টালজিয়া-অহংকার, সেই রসগোল্লা কিন্তু নিমন্ত্রিতদের পাতে পড়েছে অনেক পরে। অন্তত, গ্রামের দিকে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও রসগোল্লার চল সেভাবে ছিল না।
আমাদের যে গ্রামের কথা লিখেছি শুরুতেই, হাওড়া-হুগলি সীমান্তের সে ঝিকিরা গ্রামের বাজারে সবচেয়ে পুরনো মিষ্টির দোকান ‘বিল্লমঙ্গল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ (‘বিল্বমঙ্গল’ নয়)। নামের বোর্ড বসেছে হালে, কিন্তু কয়েক দশক ধরে দোকানের ভূতপূর্ব মালিক বিলুরাম দাসের নামে ‘বিলে ময়রার দোকান’ হিসেবেই সকলে চেনে। ঝিকিরা বাজারে বিলে ময়রার দোকানটি খুলেছিলেন তাঁর ঠাকুরদা, সেই হিসেবে চারপুরুষের এ দোকানের বয়স একশোর আশেপাশেই। একসময়ে চিংড়াজোল, রাউতড়া, শিবগাছিয়া, পাইকবাসা, বোয়ালিয়া, আশেপাশের এমন নানা গ্রামের যজ্ঞিবাড়িতে গিয়ে হাজার হাজার পিস মিষ্টি তৈরির বরাত পেত এই দোকান। এখানেই বিলুরামের ছেলে বিপ্লব দাসের কাছ থেকে শুনছিলাম দীর্ঘ সময় অবধি রসগোল্লার ব্রাত্য থাকার কাহিনী। সে সময়ে চিনি পাওয়া যেত না সহজে, শুধু দামের জন্য না, প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞারও ব্যাপার ছিল। চিনি তৈরি হতো  আখের গুড় থেকে। মাটির কলসিতে গুড় রেখে দেওয়া হতো , তলায় থাকত একটা ছোটো ফুটো, সে ফুটো দিয়ে তরল অংশ বেরিয়ে যেত, কলসিতে পড়ে থাকত শক্ত চিনি। ওই চিনি দিয়ে তৈরি হতো  মাখা সন্দেশ, দানাদারের মতো মিষ্টি, আর গুড় কাজে লাগত বাতাসা কিংবা কারকাণ্ডা তৈরি করতে, রসগোল্লা তৈরির ‘শহুরে’ পদ্ধতিটি সে বিশ্বায়ন-পূর্ববর্তী যুগে গ্রামের ময়রাদের কাছে সহজলভ্য ছিল না।

হালুইকর, ঠাকুর, ভিয়েন থেকে ক্যাটারিং—বাঙালি নেমন্তন্নের প্রজন্মান্তর
সোহম দাস

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।