আহাম্মকের খুদকুড়ো।। দুর্লভ সূত্রধর।।

"ভারতীয় সেনা ঢোকে ঢাকা শহরে!

সুতো ছাড়ার সময় যাঁরা ছিলেন, সুতো গোটানোর সময় তাঁদেরই ব্যস্ত দেখা যায়। শরণার্থী শিবিরগুলো ভেঙে ফেলা হয়, স্কুলগুলো খালি হতে থাকে। মানুষজন ফিরে যেতে থাকেন তাঁদের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাসভূমিতে— পোড়া ভিটে, ভাঙা গ্রাম আর চালের ওপর একদা যত্নে তুলে দেওয়া লাউ-চালকুমড়ো লতার সবুজে, ঘরের পাশের গাঁদা গাছটির সান্নিধ্যে।

শিবেশ্বরদার কবিবন্ধুও ফিরে যান দেশে, স্বাধীন দেশে—তাঁকে আবার কবিতার কাগজটা বার করতে হবে। আতিথ্যের জন্য ধন্যবাদ আর তাঁর কাগজে লেখার জন্য সকলকে দরাজ আমন্ত্রণ জানিয়ে যান তিনি— এমন-কী এই আমন্ত্রণ থেকে কবি চঞ্চলও বাদ যায় না। 

ফলত দাদার সঙ্গে আমীরাও ফিরে যায়। 

এই শহর, তার পুরোনো পুরোনো বাড়ি, সোঁদা-গন্ধের শতাব্দী-প্রাচীন স্কুলবাড়িগুলি তেমনই রয়ে যায়। থেকে যায়— এক-একটি অঞ্চলে জড়াজড়ি করে এক এক সম্প্রদায়ের বিভাজিত বাসভূমি।

যেদিন আমীরারা চলে যায়, তার পরদিন গিয়ে মেজর দেবেশ্বরকে বাড়িতে পাই না আমরা।
তাকে আবিষ্কার করি বেজনা বিলের ধারে। 

দেবেশ্বরের রোগাটে মুখে, সর্বাঙ্গে স্বপ্নঘোরের মতো বিষাদের আল্পনা। সহসা মনে হয়— একটা কুসুম-কুসুম গন্ধ, শব্দহীন কবোষ্ণ এক ছায়া, মোমের মতো মসৃণ দর্শনাতীত-স্পর্শাতীত এক অনুভূতি— এসবের গভীরে এক অপ্রতিরোধ্য বেদনা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বিম্বিত বিলের জলে। 

শহরে মিছিল বেরোয়। 
অর্থাৎ শহর স্বাভাবিক হয়ে আসে। 

স্কুল-কলেজ খুলে যায়। বাজারে আবার থলি হাতে অভিভাবকদের গল্প করতে, দরদাম নিয়ে অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করতে দেখা যায়। 

এত বড়ো একটা রাষ্ট্রীয় ক্রান্তিকালে যে-যার কাজে ব্যস্ত থাকায় এই সাত-প্যাঁচালো শহরে কানাকানি হওয়ার অবকাশ থাকে না। সিনেমা হলগুলি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে, ব্ল্যাকারদের ব্যবসায় সামান্য মন্দা দেখা যায়, দেবানন্দ জ্যাকেট গায়ে সামান্য ঘাড় কাত করে দেওয়ালে দেওয়ালে তাকিয়েই থাকেন।  

লিডার, মেজর দেবেশ্বরের বুক খোলা জামার ভেতরে স্তব্ধ হয়ে থাকা অভাবিতপূর্ব বেদনার খোঁজ রাখার সময় থাকে না কারও। কিন্তু আমরা? মাণিক্য বলে—'দেবেশ্বরটা যেমনই হোক, আমাদের রিপাবলিকেরই তো পাবলিক!'

মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতদেহের স্তূপ পেরিয়ে, জাহির রায়হানের ঠিকানার চিরকূট উড়িয়ে আলো জ্বলে ঢাকা শহরে। কবিতায় ভরে ওঠা চঞ্চলের খাতাটি আচ্ছন্নতা আর গাঢ় অবসাদে ভারি হয়ে ওঠে। 

শহরে মিছিল বেরোয়। 

ইস্কুলের ঘরদোর ভালো করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, ব্লিচিং-টিচিং ছড়িয়ে রঙ করার পর আমাদের রিপাবলিক খুলে যায়। 

প্রথমদিনের প্রেয়ারেই হেডস্যার যুদ্ধজয়কে অভিনন্দন জানিয়ে কেন যেন ঈষৎ অনুচ্চ স্বরে বলেন—'স্বাধীনতা বেঁচে থাকুক আমাদের ইচ্ছার মধ্যে।'

আমরা আগের মতোই খেলতে যাই, লাইব্রেরি যাই, বই পড়ি, রিপাবলিকের সবেতেই নাক গলাই, ক্লাসে আসার আগেই কানাইবাবু স্যারের কচার ডালটাকে লুকিয়ে ফেলি, ক্রমাগত আজেবাজে এলোমেলো ইচ্ছামাফিক প্রশ্ন করে সুধন্যবাবু স্যারকে জ্বালাতন করি, বাবুদের আম, কালো ঠাকুমার বাতাবি গেঁড়িয়ে নিয়ে আসি, আগামী বিশ্বকর্মায় কী কী ক্যাটাভেরাস করা যায় তার পরিকল্পনা ভাঁজতে থাকি, ক্রিকেটে ভারত জিতলে গলা ফাটাই। 

এরই মধ্যে বাজার করতে গিয়ে মুগা-বাজারের দশকর্মার লাইনের শেষপ্রান্তে নদীঘাটের সেই বেতসলতা মেয়েটিকে দেখতে পায় আমাদের বরুণ। মায়ের সঙ্গে ঝুড়ি, সাজি বিক্রি করতে এসেছে সে। কী নাম যেন— নিজের কাছে লুকোতে পারে না বরুণ— বাঁশি! আগেও নিশ্চয়ই মেয়েটি মায়ের সঙ্গে বার বার এসেছে! কৈ তখন তো মা-মেয়েকে কিংবা মেয়েটির কাঁচের চুড়িতে, নাকছাবিটির ছিলা-কাটা বিন্দু-পাথরে অরোরার ছটা নজরে আসেনি!

আসলে এই ক্রান্তিকালে, এমন যুদ্ধ-সময়ে ছেলেরা দ্রুত বড়ো হয়ে যায়।"
.
.
.
.
আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।