বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

আঠারো শতকের শেষ থেকেই ডাক রানারের নিয়োগকে কেন্দ্র করে কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে সচেতন পদক্ষেপ রাখতে লক্ষ করা যায়। এই সময় প্রায় সর্বত্রই পোস্টমাস্টার এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের পক্ষ থেকে স্থানীয় কৃষকদের কাছে রানার হিসেবে কাজ করার জন্য আবেদন রাখা হয়।

ঐতিহ্যগতভাবে যারা গ্রাম সমাজের ভিত্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল, সমাজের নিম্নস্তরের সেই সামাজিক শ্রেণি থেকেই ডাক রানার হিসেবে নিয়োগ করা হতো। যদিও সরকারি আধিকারিকদের পক্ষ থেকে উদারনৈতিক নীতির মাধ্যমেই নিয়োগ প্রক্রিয়ার কথা বলা হত, বাস্তবে অবশ্য কোম্পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য রানার পদে যোগ দিতে বাধ্য করা হতো।

উনিশ শতকের প্রথম ভাগের সরকারি চিঠিপত্রে পোস্টাল কর্তৃপক্ষকে সাধারণত সুস্থ, সবল এবং সক্রিয় ব্যক্তিদেরই এই চাকরিতে নিয়োগ করার কথা বলা হয়। নিয়োগের সময় ডাক রানারদের কানে মন্ত্রগুপ্তির মত প্রবেশ করানো হতো যে তারা কোম্পানির রানার। এর অন্যতম প্রধান কারণ তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করা এবং কোম্পানি এলাকার বাইরেও তাদের কাজের উৎসাহ বৃদ্ধি করা।

ক্রমশ ডাক রানারদের নিজেদের প্রাপ্য নিয়ে সরব হতে দেখা যায়। কারণ ততদিনে কোনো কোনো ডাক সড়কে, বিশেষ করে জঙ্গলের পথগুলিতে ডাক হরকরাদের একছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। কোম্পানির পক্ষে এদের পরিবর্তন করে নতুন ব্যক্তিকে নিয়োগ করাও অসম্ভব ছিল। কারণ নতুনভাবে নিযুক্ত রানারদেরকে অভিজ্ঞরা নানা ধরনের ভীতি প্রদান করত যার ফলে কোম্পানির পক্ষে নতুন লোক নিয়োগ করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল। কোথাও কোথাও ডাক রানারদের ধর্মঘট কোম্পানির ডাক ব্যবস্থাকে সাময়িকভাবে অচল করে দিয়েছিল। ক্রমশ কোম্পানির পক্ষ থেকে অভিজ্ঞ এবং পোক্ত রানারদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়ার একটা প্রবণতা এসেছিল উনিশ শতকের প্রথম ভাগের শেষ দিকে।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের প্রথম দিকে বিশেষ করে মহাবিদ্রোহের অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে এজেন্সির মাধ্যমে ডাক রানার নিয়োগের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই এজেন্সিরা 'ডাক মুন্সী' নামে পরিচিত ছিল, যারা রানার সরবরাহের মাধ্যমে প্রভূত মুনাফা অর্জন করত। ডাক রানারদের দৌড়ের গতি নিয়ে এই ডাক এজেন্সির সঙ্গে কোম্পানির নানা ধরনের অশান্তি প্রায় লেগেই থাকতো। কোম্পানির পক্ষ থেকে ডাক রানারদের গড় গতি ঘন্টায় ৫-৬ মাইল হিসেবে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে ডাক এজেন্সিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই গতি সুনিশ্চিত করা সম্ভব শুধুমাত্র ভালো আবহাওয়া এবং ডাক সড়কের অনুকূল অবস্থার উপর। অন্যদিকে বহন করা ডাকের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও এই গতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হতো না। এ নিয়ে উনিশ শতকের বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের অশান্তির সংবাদ পাওয়া যায়।

অন্যদিকে সরকারিভাবে রানারদের যে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো, এজেন্সির পক্ষ থেকে সেই অর্থ রানারদের দেওয়া হতো না। ফলে একদিকে রানাররা তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হতো, অন্যদিকে ঠিকাদার ক্রমশ তার মুনাফা বৃদ্ধি করত। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ডাক রানারদের পক্ষ থেকে রংপুর এবং ভাগলপুরের পোস্টমাস্টারের কাছে দেওয়া দুটি অভিযোগ পত্র থেকে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে রানারদের অভিযোগের একটা ধারণা পাওয়া যায়। উভয় আবেদনেই বলা হয়েছিল, তারা তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঠিকাদাররা অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে, বিষয়টি ক্রমশ ডাকঘরের সীমানা পার হয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এলাকায় প্রবেশ করেছিল।

লক্ষ করলে দেখা যাবে ডাক রানারদের গতি এবং পারিশ্রমিককে কেন্দ্র করে বিরোধ সারা ভারতবর্ষ জুড়েই কোম্পানির শাসন পার হয়ে মহারানীর শাসনেও প্রবেশ করেছিল। আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো কোম্পানির বিরুদ্ধে রানারদের নিজেদের সংগঠিত হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এজেন্সি প্রথা। কারণ কোম্পানির পক্ষ থেকে সব সময়ই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এজেন্সির মাধ্যমে রানার নিয়োগের উপর। ফলে রানারের গতি, পথের প্রতিবন্ধকতা এবং পারিশ্রমিক - এই সকল বিষয়কে কেন্দ্র করে উপনিবেশ শাসকের সঙ্গে দর-কষাকষি হয়েছে এজেন্সির - ডাক হরকরার নয়।

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের পোস্ট অফিস আইন ডাক ব্যবস্থায় অনেকগুলি সংস্কার সাধন করেছিল। ওই শতকের মাঝামাঝি সময়ে রেলওয়ে মেল সার্ভিস বহু দূরবর্তী এলাকায় ডাক যোগাযোগ সুনিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে এই শতকেই টেলিগ্রাম ব্যবস্থা ডাক যোগাযোগে নতুন যুগের সূচনা করেছিল। ফলে সারা দেশের দুর্গম পার্বত্য এলাকায়, যেখানে রেল যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি, এমনকি বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়েও, একমাত্র সেখানেই বিচ্ছিন্নভাবে ডাক হরকরার অস্তিত্ব বজায় ছিল।

ডাকঘরের হরকরা
উৎপল চক্রবর্তী
................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।