বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।


'ষোড়শ শতকেও এই জনপদ বেশ সমৃদ্ধ ছিল। মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে তার আভাস পাওয়া যায়। চণ্ডীমঙ্গলের অন্যতম নায়ক ধনপতি সদাগর উজানি নগর থেকে সিংহলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেদিনের উজানিনগর আজকের কোগ্রাম, বৈষ্ণব সাধক লোচন দাসের জন্মভূমি। মাটিয়ারি-কাটোয়া নিকটবর্তী এই স্থান। মুকুন্দ চক্রবর্তীর বর্ণনা অনুযায়ী ধনপতি সদাগরের বাণিজ্যতরী ভাটার টানে অজয় থেকে আসে গঙ্গায়। এই বাণিজ্য যাত্রায় উঠে আসে মাটিয়ারি জনপদের কথা—
লহনা খুল্লনা ঠাঁই মাগিল মেলানি।
বাহিল অজয় নদী পাইক ইন্দ্রাণী।। 
ভাউসিংহের ঘাটখান ডাহিনে রাখিয়া।
মেটিরির ঘাট যায় বামে তেয়াগিয়া।।
(চণ্ডীমঙ্গল, বসুমতী সংস্করণ, ১৬১ পৃষ্ঠা)
ভাগীরথী তীরবর্তী মাটিয়ারির জনপদ তৎকালে খুব সামান্য ছিল না বলেই বর্ধমান জেলার প্রান্তদেশের কবি তাঁর কাব্যে এই স্থানের নাম এড়িয়ে যেতে পারেননি।
যেমন এড়িয়ে যেতে পারেন নি নবদ্বীপকেও—
পুরধুলি সদাগর করি তেয়াগন
নবদ্বীপে ডিঙ্গা আসি দিল দরশন।
চৈতন্যচরণে সাধু করিআ প্রণাম
সেখানে রহিআ সাধু করিল বিশ্রাম।
এই জনপদগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ভাগীরথীর জলপথপরিবহন। দাঁড়-পাল-গুন-টানা মাঝিদের ওপর ভর করেই এই জনপদগুলির বানিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল বহুপূর্বেই।
অষ্টাদশ শতক। পলাশীর যুদ্ধ। বাংলার শাসনব্যবস্থার পট পরিবর্তনের কাল। নবাবের পরাজয়ে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হল বৃটিশ শাসন। ঐতিহাসিক এই পট পরিবর্তনের পূর্বে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতবর্ষের অবদান ছিল ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলার অবদান ছিল ১২.৫ শতাংশ। পলাশী যুদ্ধ বিজয়ের পর লর্ড ক্লাইভের সময় বাংলার বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়ে যায়। ১০০ নৌকা মুর্শিদাবাদ লুঠের মাল নিয়ে কলকাতার হুগলি নদীতে নোঙর করে। বাংলার নিঃস্ব হয়ে ওঠার এই অধ্যায়ের সাক্ষী ছিল নৌকা। সাক্ষী ছিল অষ্টাদশ শতকের মাটিয়ারির জনপদ। সেদিনও হয়তো সার সার নৌকার অভিযান দেখতে ভিড় করেছিল মাটিয়ারির মানুষ নদীপাড়ে। সচেতন বঙ্গবাসী বিস্ময় নয়, শঙ্কা নিয়ে ফিরেছিলো ঘরে। যেদিন বুড়িগঙ্গার জলে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে বাংলার মানুষের কাছে ঘৃণিত ঘসেটি বেগমের করুণ মৃত্যু দৃশ্য রচিত হয়েছে সেদিনও সাক্ষী ছিল নৌকা। প্রবহমান এই সময়ের ধারায় ইতিহাসের ধুলো মেখে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে গুন-টানা নৌকার মাঝিরা।
মাটিয়ারি গ্রামের অর্থনীতির মূল ভিত পিতল শিল্প। তবে এই শিল্প অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকের পূর্বে এই গ্রামে গড়ে ওঠেনি। পিতল শিল্পটি ভাগীরথীর অপর পাড় দাঁইহাটে গড়ে উঠেছিল সুলতানী আমলেই। ১৭৪২ সালে বর্গী হানা বাংলার বিস্তীর্ণ অংশকে বিধ্বস্ত করেছিল। মারাঠা দস্যুদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছিল কাটোয়া ও দাঁইহাটের জনপদ। বর্তমান দাঁইহাটের উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় মারাঠারা শিবির গড়ে তুলে নিকটবর্তী অঞ্চলে লুঠপাট ও সন্ত্রাস চালায়। নারী সম্ভ্রম রক্ষা ও মৃত্যুভয়ে বর্গীহানাকালে দাঁইহাটের পিতল শিল্পীদের বেশ কিছু অংশ ভাগীরথী পেরিয়ে মাটিয়ারি চলে আসে। কিছু অংশ কলকাতা সিমলে অঞ্চলে চলে যায়। ১৭৫১ সালের পর মারাঠা দস্যুদের ভীতি কমে গেলেও পিতল শিল্পীরা আর দাঁইহাটে ফিরে আসেনি বা দূরে কোথাও চলে যায়নি। কারণ তৎকালে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদিত মাল রপ্তানিতে পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল ভাগীরথীর জলপথ। বড়ো বড়ো মালবাহী বাতনাই বা ঘাসি নৌকায় দাঁড়, পাল ও গুন-টানা মাঝির ওপর ভর করে মাটিয়ারির পিতল শিল্পে উৎপাদিত মাল পৌঁছে যেত ভিনরাজ্যে। জলপরিবহনের এই ভিত বহু পূর্বকাল থেকেই এই জনপদে ছিল।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে ভাগীরথীর পাড়ে মাটিয়ারি গ্রামে বসতি গড়েন অধুনা বাংলাদেশের হৃদয়পুরের বাসিন্দা রামলাল সেন ও রাজশাহী জেলার মাধবচন্দ্র সেন। এই দুই সেন পরিবার অর্থ ও প্রতিপত্তিতে প্রায় জমিদার-সমকক্ষ হয়ে ওঠে। এই অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির মূল ভিত্তি ছিল পিতল শিল্প। দুই সেন পরিবারের নদী তীরবর্তী স্থানে বসতি গড়ে তোলার মূলে ছিল পিতল শিল্প ও তার পরিবহন সুবিধা। তৎকালে কলকাতা সহ অন্যান্য বাণিজ্য কেন্দ্রের সঙ্গে এই অঞ্চলের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল জলপরিবহন। ১৮৮০-৮২ সাল থেকে ইংল্যান্ডের তৈরি পিতলের চাদর আমদানি শুরু করে রামলাল সেনের পরিবার। কলকাতার জাহাজঘাটা থেকে পুরো একটি জাহাজের মাল তারা ক্রয় করে নিতেন। এরপর কলকাতা থেকে ভাগীরথীর জলপথে বড়ো বড়ো মালবাহী গুন-টানা নৌকায় পিতলের চাদর আসতো মাটিয়ারি গ্রামে। এরপর এজেন্ট মারফৎ খুচরো ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যেত এই পিতলের চাদর। বর্তমান সময়ে এই শিল্পে উৎপাদিত বাসন-কোসনের ১০০% সড়ক ও রেল পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্রে পৌঁছে যায়।
বর্তমান সময় থেকে ৩০-৩৫ বছর পূর্বেও মাটিয়ারি জনপদ জলপরিবহনে গুনটানা নৌকাতেই অভ্যস্ত ছিল। এখনও সেই স্মৃতি গ্রামের মানুষের কাছে মলিন হয়নি। উজান-ভাটিতে বয়ে যাওয়া গুন-টানা নৌকা, মাঝি-মাল্লাদের গান, লণ্ঠনের আলোয় আমোদ আলির নৌকার মাঝিরা রান্না চাপায়। নৌকা থেকে ভেসে আসে অড়হড় ডালের গন্ধ। নদীপাড়ের এই সমস্ত চিত্র এখনও জীবন্ত গ্রামের প্রবীণদের চেতনায়। এই তো সেদিনের কথা! সাড়ে দশটায় নৌকা ছাড়বে। দু-আড়াই ঘণ্টার পথ, পালা পার্বণের কেনাকাটায় কাটোয়া শহরের বাজারই ভরসা। ভরসা আমোদালি ও ছাইবর মাঝির গুন-টানা নৌকা। ১০টা বাজতেই পুরুষ মানুষ নৌকার ছই-এর মাথায় ভিড় জমায়। বাসি কাগজ মগজ থেকে বেরিয়ে আসে ছইয়ের মাথায়। উজান পথে পেরিয়ে যায় কাশবন।
ছই-এর ঘরে পা ছড়িয়ে গল্প করে অন্তঃপুরবাসিনীরা। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কিশোরী মেয়ে আদর করে গঙ্গাজল। ছোট্ট ছেলেটির মায়ের কোলে বসে একই প্রশ্ন বারবার—আর কতদূর মা? তিন-চারটে পাথর শরীর তখন বুকের একপাশে গুনের দণ্ডটাকে চেপে ধরে ঝোপঝাড়, বন মাড়িয়ে এগিয়ে যায়। কাটোয়ার ঘাটে নোঙর করে নৌকা। দু-আড়াই ঘণ্টার কেনাকাটা-রূপসী, পদশোভা, তারাপদ খাঁ, দত্ত ব্রাদার্স। তারপর আবার ছই-এর মাথায় গল্পের আসর—কার দোকানে কতটা স্টক, কার-বা দামে ঠিক। ভাটির পালে হাওয়া লাগলে দু ঘণ্টার পথ অর্ধেক হয়ে যায়। মাঝিরা নৌকা খালি করে শীতল জলে গা ভাসায়। নদীর পাড় জুড়ে সন্ধ্যা নামলে নৌকায় নৌকায় দীপ জ্বলে ওঠে। নদী জ্যোৎস্না মেখে আহ্লাদী হয়ে উঠলে আমোদ আলি কণ্ঠে তুলে নেয় লালন ফকির। নৌকার ছই-এর ভিতর থেকে ভাতের গন্ধ ছড়ায়। নদী পাড়ে ঘুরতে আসা বাতাসবিলাসীরা খোঁজ নেয়—'আজ কী রেঁধেছো চাচা?' ছই-এর ভিতর থেকে উত্তর আসে— 'অড়হড় ডাল আর আলুর ছক্কা।' শরীর বাঁচাতে যতটুকু প্রয়োজন, আয়োজন ততটুকুই। ছই-এর ভেতর রাত নামে। কাকভোরে গরুর গাড়িতে মাল বোঝাই হয়ে আসে নদীঘাটে। পিতলের হাঁড়ি গামলা জগ নানান বাসনপত্র বোঝাই হয় নৌকায়। আবারও কর্মব্যস্ততা। নির্বাক যন্ত্রের মতো কাঁধে গুন তুলে নিয়ে এগিয়ে যাবে মাঝিরা নদীর কিনারা দিয়ে। ঝড় আসে, বৃষ্টি আসে, মেঘ গর্জায়, তবুও থামে না হাঁটা। আগুন ঝরা রোদে তারা হাঁটে। নদীর প্রচণ্ড টানের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে, ঘামে ভিজে ওঠা শরীর থেকে পিছলে যায় গুনের দণ্ড। ছিটকে পড়ে নদীতে, ঝোপে-ঝাড়ে। সেগুলি আবার কুড়িয়ে নিয়ে হেঁটে চলে। তাকে নৌকা ভিড়াতেই হবে গন্তব্যের ঘাটে।'
.
.
হারিয়ে যাওয়া আমোদ আলি, নিরঞ্জন মাঝিরা
গোবিন্দ বিশ্বাস 
..............................................................
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।