বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

'দিন-কয়েক পর থেকেই অদ্ভুত এক যাত্রা শুরু হলো সুমনের। দু-দিন আগেই এমন জীবনের কোনো প্রকল্পনা তাঁর নিরালম্ব-শূন্যতায় বেপথু হাওয়া হয়েও প্রবেশ করেনি।
হাটতলা পেরিয়ে খানিক এগিয়ে তেঁতুলতলা মোড়ে গোপাল বাড়ুজ্যের শালার বাড়িতে একটা ঘর নিয়ে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হলো। সুধাময় আর তাঁর নবলব্ধ বন্ধুরাই চৌকি-বিছানা, মশারি-বালিশ, লেপ-কাঁথা প্রয়োজনীয় চায়ের সরঞ্জামের ইন্তেজাম করে ফেললেন। দোকানের ফাঁকে ফাঁকে সুধাময় তাঁকে সদরে নিয়ে গিয়ে রং-তুলি ইতি-ইত্যাদি কিনে দিল। আড্ডাড়ুদের মধ্যে কাঠমিস্ত্রি ছিল খোকন শেখ। সে-ও সাইন বোর্ড নির্মাণে তাঁর সঙ্গে লেগে গেল। সদর থেকে এক-টুকরো ভালো ও মোটা টিন এনে গোপাল বাড়ুজ্যের বাড়ির পুরোনো কাঠ থেকে বাটাম বের করে তাই দিয়ে বাঁধিয়ে সাইনবোর্ড তৈরি হয়ে গেল। তার ওপরে হালকা ক্রিম কালার লাগিয়ে তার ওপর ডার্ক-ট্যান রঙে পুরোনো পুঁথির হরফে লেখা হলো 'রাধাকৃষ্ণ টেলার্স', তার তলায় বিদ্যাসাগরীয় ফেস-ফন্টে টেলার অ্যান্ড আউট ফিটার্স। তার তলায় প্রো : গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ডার্ক-ট্যানের এক-একটি শেডে এক-একটি লাইন। সঙ্গে ডানদিকের কোণায় শ্রীকৃষ্ণের শিখীপুচ্ছ আর রাধার নূপুরের প্রতীকী সাইন! দু-তিন দিনের মধ্যেই খোকন শেখ লোহার কড়া আর ক্লিপ টিপ দিয়ে দোকানের বাহির-বাগে টাঙিয়ে দিল সেই বোর্ড।
গোটা গঞ্জে সত্যিই 'রাধাকৃষ্ণ টেলার্স'-এর নাম একেবারে ফেটে গেল।
প্রথমে গোপাল বাড়ুজ্যে আর গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে একটু খটমট বেঁধেছিল, পরে সেটা জলের মতো হয়ে গেল সাইনবোর্ডে রাধাকৃষ্ণ টেলার্স আর গোপাল বাড়ুজ্যের দোকান দুটোই থাকল। তার সঙ্গে শিখীপুচ্ছ আর নূপুর একবারে হিট করে গেল।
রেলবাজারের ব্যাপারি থেকে শুরু করে গঞ্জের দোকানদারেরা ঘুরে-ফিরে সাইনবোর্ড দেখে গেল, স্থানীয় মানুষও সাইনবোর্ডওয়ালা দর্জির দোকান দেখে অবাক!
এই কাজের জন্য গোপাল বাড়ুজ্যে সুমনকে দিলেন সাজ-সরঞ্জামের দাম ছাড়াও একশো টাকা নগদ দক্ষিণা। সে-সময় ও তাঁর অবস্থার বিচারে একশো টাকা বড়ো কম ছিল না। তিনি নিতে চাননি, কিন্তু গোপাল বাড়ুজ্যে ছাড়েননি।
এই হলো শুরু।
বাবু লালার নাতি তিনু পোদ্দারের দোকানে এতকাল মজুত ও মূল্য তালিকা ছোটো ব্ল্যাকবোর্ড আর শ্লেটে চক দিয়ে লিখেই চলে গেছে, এবার তিনু পোদ্দার সুমনকে দিয়ে কালোর ওপর সাদা রঙ দিয়ে খোপ-কাটা দুটো বোর্ড করিয়ে নিলেন। কাঠের লম্বা পাটার চারপাশে খোকন শেখের হাতে সরু ওভাল-টপ বাটামের বর্ডার একেবারে হিট করে গেল। অভিজ্ঞতা থেকে পরে সুমন এম আর ডিলার বা অখিল মণ্ডলের রেশন দোকানের প্রাইস লিস্ট আর স্টক-বোর্ড বানাবার সময় এমন বর্ডারের জন্য সূর্যি লেটের ফটো-বাঁধাইয়ের দোকান থেকে ফ্রেমের রেডিমেড বাটাম আনিয়ে নিলেন।
এবার সাহা সু হাউজ, মা তারা বস্ত্রালয় থেকে শুরু করে কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার পর্যন্ত সকলেই সাইনবোর্ড লেখাতে শুরু করে দিলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই গঞ্জ-বাজারের, দোকানপাটের চেহারা বদলে গেল। এমন-কী রেল লাইনের পুবপারে বিস্তীর্ণ মাঠটার শেষে ধোঁয়া ধোঁয়া যে ছোট্ট খুদ্দক টিলাটা দেখা যায়, তার কাছের ইতস্তত পাথরের টুকরো-ছড়ানো মাঠটায় জানুয়ারির কড়া- শীতে যে পীরবাবার মেলা বসে তার বিজ্ঞাপনের জন্য মেলার মুরুব্বিরা দশটা কাপড়ের ব্যানার তৈরি করে নিয়ে গেলেন। বাড়ির নেমপ্লেট, ইস্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টারমশাইদের নামের তালিকা- সম্বলিত অনার-বোর্ড, রাজ্য সড়কে বাস স্টপেজের কাছে সারি সারি হোটেলের সাইনবোর্ড থেকে মেনুবোর্ড, লেটার বক্স-অজস্র অর্ডার আসতে লাগলো।
এত কাজ সামলানোর জন্য সুমনের দুটি সহকারিও জুটে গেল। এরা ভালো অক্ষরশিল্পী, ভোটের সময় বা জনগণকে আন্দোলনের খবর দিতে মাটির হাঁড়িতে গুঁড়ো শিরীষের আঠা দিয়ে ব্লু, এলা মাটি, কিংবা ইদানিংকালে ফ্লুরোসেন্ট রঙ গুলে দেওয়াল লেখে। এরা অ্যামেচার, বামদলের কর্মী।
কাজের চাপ, রোজগারের ধারাবাহিকতা, নতুন কিছু করার উত্তেজনায় সুমনের ভেতরে যে দ্বিধা কাজ করছিল তা অপসৃত হলো। এর মধ্যেই প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন তিনি। খোকন শেখের সহায়তায় কাঠের অক্ষর দিয়ে বোর্ড বানালেন, মিষ্টির দোকানের শো-কেসের গায়ে কিংবা কাপড়ের দোকানের কাউন্টারের সামনের দিকে কাঁচের গায়ে বিবিধ আকর্ষণীয় উজ্জ্বল রঙ দিয়ে উইন্ডো রাইটিং করে দিলেন, বয়েজ আর গার্লস ইস্কুলের গেটের ওপর লোহার শিট দিয়ে অর্ধ-ডিম্বাকৃতি বোর্ড বানিয়ে তাতে পালিশ-করা পিতলের পাতকে বক্স-অক্ষরে রূপ দিয়ে ইস্কুলের নাম লিখে দিলেন।
পাথরে, কাঠে, পিতলের পাতে, টিনে, লোহা বা জি-আই শিটে, করোগেট শিটের সাইনবোর্ড বানালেন তিনি। শুধু নিত্য-নতুন উপকরণ ব্যবহারই নয়, নানা ছাঁদের অক্ষর লিখে তিনি একেবারে তাক লাগিয়ে দিলেন।
এখানে যদি উপকরণ সংগ্রহের এবং কারিগর পাওয়ার সুবিধা থাকত তবে তিনি আরও বৈচিত্র্যের চর্চা করতে পারতেন। আর্ট কলেজে পড়ার সময় এসবের চর্চা কিঞ্চিৎ করতে হয়েছিল প্রথমে দায়ে পড়ে, পরে নিজের আগ্রহ থেকেও জান-পহেচান বেড়েছিল অনেকটা।
তাছাড়া সাইনের, সাইনবোর্ডের বৈচিত্র্যের, বিভিন্নতার বা প্রকারের তো সীমা নেই। তেমনভাবে দেখতে গেলে লিখিত বর্ণ ব্যবহারের আগেই মানুষ চিহ্ন বা সাইন ব্যবহার করতে শুরু করেছিল, গুহাচিত্রকে তেমনই ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবপ্রকাশক ভাষ্য বা জ্ঞাপন বলে মনে করা যেতে পারে। বিশেষ কিছু জ্ঞাপনের জন্যও একদা এসব চিত্রভাষ্য সৃজিত হয়েছিল। উত্তরকালে কবে যে এই বিশেষভাবে জ্ঞাপিত ভাষ্যের সারল্য বিজ্ঞাপনের রূপ নিয়ে মুনাফার কালিমাকলুষের সঙ্গে বিজড়িত ও বিজারিত হয়ে গেল, সে ইতিহাসের দিনক্ষণের হিসেব পাওয়া যাবে না!'
.............................................................
লেখালেখির শিল্পীরা
সমরজিৎ দাস
.............................. 
বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৬৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।