রহু চণ্ডালের হাড়।। অভিজিৎ সেন।।

রহু তার মানুষ নিয়ে সেই ভূখণ্ডে থাকত, যেখানে জীবন ছিলো নদীর মতো, নদীতে ছিলো অফুরন্ত স্রোত, বনে অসংখ্য শিকারের পশু এবং মাঠে অজস্র শস্য। মানুষ ছিলো স্বাধীন, সুখী।
    তারপর সেই মানুষটা এলো। তার চোখ স্থির, তাতে পলক পড়ে না। সে এসে প্রথমেই মাঠ থেকে বহর সেরা ঘোড়াটি ধরে নিলো।
    এই ঘোড়া আমার।
  কেউ কোনও প্রতিবাদ করেনি। সবাই তাকিয়ে দেখছিলো তাকে। সে কিছু স্বতন্ত্র, রহুর মানুষদের সঙ্গে তার মিল নেই।
    সে ঘোড়াটা ধরে নিলো এবং তাতে সওয়ার হলো। কিন্তু ঘোড়াটা তাকে সওয়ার করতে রাজি হলো না। তাকে ছিটকে ফেলে দিল। সে ক্রুদ্ধ হলো এবং আবার সওয়ার হলো। ঘোড়া আবার তাকে ধুলোয় ফেললো।
    ক্ষিপ্ত মানুষটা তখন কোষ থেকে খড়্গ নিষ্কাশন করলো। ঘোড়া তার সামনে ঘাড় সোজা করে বেয়াড়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ক্ষিপ্ত ও ক্রুদ্ধ মানুষটা এক কোপে সেই দুর্বিনীত স্বাধীন ঘোড়ার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করলো।
    সব মানুষ হতবাক হয়ে গেলো। এমন পাশবিক হত্যা সেখানে কেউ কোনোদিন দেখেনি। সবাই স্তব্ধ।
    তখন সে মানুষটা হা-হা করে হাসলো। তাতে সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল এবং তাকে শাস্তি দিতে চাইল।
    অদ্ভুত! সেই মানুষটার চোখে মুখে কোনও আতঙ্ক নেই! 
    রহু তখন নিরস্ত করলো তার মানুষদের! রহু সেই স্কন্ধহীন ঘোড়াটা দেখালো সবাইকে। সেই দুর্বিনীত ঘোড়াটা তখন সমস্ত মাঠ বৃত্তাকারে ঘুরছে। বৃত্ত ক্রমশ বড়ো হয়, ক্রমশ আরও বড়ো। ঊর্ধ্বমুখে উৎক্ষিপ্ত রক্ত সেই বৃত্ত তৈরি করে।
    সব মানুষ সভয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলো। রহু তখন সেই আগন্তুককে বলে, তুমি ওকে মারলে কেনো?
    ও আমার অবাধ্য হয়েছিলো।
    কিন্তু ও তো তোমার পশু নয়। 
    সে হা হা করে হাসে। সে বলে, আমি যা চাই, তাই পাই।
    তুমি পরিশ্রম করে অর্জন করো না?
    সবাই অবাক হলো তার উত্তর শুনে। সে বললো, আমি অর্জন করি আমার এই খড়্গের সাহায্যে। 
    তারপর সে চলে গেলো। যুবকেরা তাদের ধনুকে শরসন্ধান করছিলো তাকে বিদ্ধ করার জন্য। রহু তাদের নিষেধ করলো। কেনোনা, সে এই অদ্ভুত মানুষটাকে বুঝতে চেষ্টা করছিলো। সে অমঙ্গল আশঙ্কা করছিলো।
    যুবকেরা বলেছিলো, ওকে হত্যা করাই ঠিক ছিলো, প্রবীণেরা বলেছিলো, ওকে হত্যা করলে ওর স্বজাতির সৈনিকেরা এসে আমাদের হত্যা করতো। রহু বলেছিলো, ও এবার ওর স্বজাতীয়দের নিয়ে আসবে। ওকে হত্যা করা, না-করাতে কিছুই যায় আসে না। ওকে হত্যা করলে ঘৃণিত মানুষকে হত্যার কদর্যতা আমাদের গায়ে লাগত। 
    রহু ঠিক বলেছিলো। সে আবার এলো। এবার অনেক লোক-লশকর নিয়ে। এবার রহু তার পথ আটকাল।
    সে বললো, চণ্ডাল, পথ ছেড়ে দাও।
    কোথায় যাবো তোমরা?
    আমরা ঐ পবিত্র নদীর কাছে যাবো। 
    রহু বলেছিলো, ওই পবিত্র নদীর কাছে যাও, পবিত্র হও।
    সে আবার হা-হা করে হেসেছিলো। তারপর তারা সেই নদীর পথে এগিয়ে গিয়েছিলো।
    তারা সেই নদীর তীরে তাদের দেবতার মন্দির নির্মাণ করেছিলো, তারপর ফিরে গিয়েছিলো। ফেরার পথে তারা রহুর জনপদকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছিলো, শস্য নষ্ট করেছিলো, রমণীদের ধর্ষণ করেছিলো এবং বাধাদানকারীদের হত্যা করেছিলো। তারা ছিলো মদমত্ত ও স্বেচ্ছাচারী।
    তৃতীয়বার সে আসে আরও বলশায়ী হয়ে। এবার তার সঙ্গে ছিলো তার পুরোহিতগণ। তারা সেই মন্দিরে তাদের দেবতা স্থাপন করলো এবং তাদের বিচিত্র রীতিপদ্ধতির অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করলো।
    তারা তৃষ্ণার্ত রহুর স্বজাতিদের নদীর জল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। তখন রহু করলো তার প্রতিবাদ।
    একী স্বেচ্ছাচার তোমার?
    চণ্ডাল, এই পবিত্র নদী তোমরা স্পর্শ করতে পারবে না। এই মন্দিরের ত্রিসীমানায় আসতে পারবে না। 
    তোমার মন্দিরে আমাদের প্রয়োজন নেই, কিন্তু এই নদী এতোকাল আমাদের ছিলো। 
    এখন আর নেই। এখন এ নদী আমাদের, তোমাদের স্পর্শে অপবিত্র হবে। 
    এই বলশালীর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ করার মতো শক্তি কিংবা আয়োজন কিছুই ছিলো না। রহুর জনপদের যাবতীয় সম্পদ, শস্য, পশু, এমনকি স্ত্রীদেরও আগন্তুকরা বলপ্রয়োগে দখল করলো। তারা ক্রমশ হীনবল হয়ে দখলকারীদের বিধিনিষেধের মধ্যে অভিশপ্ত জীবন যাপন করতে লাগল।
    অবশেষে, রহু একসময় আবিষ্কার করলো, বহিরাগতদের যাবতীয় ভ্রষ্টাচার তার নিজ গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করেছে। সে তখন গোষ্ঠীর সবাইকে নিজের কাছে ডাকলো।
    আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারিনি। আমি হিংসাকে নির্দিষ্ট করেছিলোম খাদ্য সংগ্রহের নিমিত্ত পশু শিকারের মধ্যে। কিন্তু এই জনপদের বাইরেও পৃথিবী আছে, সেখানকার বিধিনিয়ম পরিবর্তিত হয়েছে, সে খবর আমি রাখিনি। সেখানে হিংসা শুধু পশু শিকারের জন্য নয়। আমি তোমাদের শিখিয়েছিলোম যে, মানুষ মাত্রেই তোমাদের ভাই, কিন্তু এ শিক্ষা ভুল। এই নবাগত মানুষেরা কখনও আমাদের ভাই হতে পারে না। এরা আমাদের অন্ত্যজ করেছে, আমাদের পবিত্র নদীর স্পর্শ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে, আমাদের মধ্যে ভ্রষ্টাচারকে প্রবেশ করিয়েছে।
.
.
.
.
রহু চণ্ডালের হাড়
অভিজিৎ সেন
.
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : শুভেন্দু সরকার
.
মুদ্রিত মূল্য : ২৯৫ টাকা 
.
সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।