মুর্শিদাবাদের নবাবি কেল্লার কথা।। ফারুক আবদুল্লাহ।।

'মীরজাফর পরবর্তী নবাবদের সাধ থাকলেও সাধ্য ছিলনা নতুন প্রাসাদ নির্মাণের। কারণ এমনিতেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নানান বাহানায় নবাবদের ভাতা কমিয়ে আসছিল। ফলে নবাবরা যা ভাতা পেতেন তা দিয়ে তাঁদের নবাবি ঠাটবাট বজায় রাখা ছিল কষ্টকর। এমতাবস্থায় তাঁদের পক্ষে নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করা ছিল বিলাসিতার নামান্তর। কিন্তু পরিবার পরিজন নিয়ে এভাবে বসবাস করাও ছিল খুব কষ্টসাধ্য। ফলে নিজামত পরিবারের পক্ষ থেকে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে তাঁদের পুরানো প্রাসাদের দৈন্যদশার কথা উল্লেখ করে নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রচুর চিঠি লেখা হয়। চিঠি পেয়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য এসে নতুন প্রাসাদ তৈরীর স্থান নির্বাচন, মাপ এবং খরচের হিসেব করেও শেষ পর্যন্ত কাজ আটকে যেত টাকার জন্য। কারণ কোম্পানি কখনোই এই খাতে খরচ করতে চাইতো না। 

ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে বিশেষ করে মীরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগমের মৃত্যুর পর তাঁর এবং নিজামত পরিবারের বাকি মৃত সদস্যদের কয়েক বছরের বকেয়া ভাতা এবং মুন্নি বেগমের ব্যক্তিগত কিছু সম্পদ (সোনা, মণিমুক্ত, হীরে জহরত) বিক্রি করে একটি তহবিল গঠন করা হয়। যদিও পরবর্তীকালে আরও কিছু তহবিল গঠিত হয়েছিল। স্থির হয় এই তহবিলের একটা বড় অংশ খরচ করা হবে নিজামত পরিবারের উন্নতিকল্পে। এই তহবিলের টাকা থেকেই কয়েকটি প্রাসাদ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল। খুব সম্ভবত নবাব হুমায়ুন জা-র আমলেই তহবিলে জমাকৃত অর্থের এক অংশ ব্যবহৃত হয়েছিল আমীরমহল বা বালাখানা নামক এই বিরাট প্রাসাদ নির্মাণের জন্য।

হাজারদুয়ারী প্রাসাদের চেয়েও আকারে লম্বা দ্বিতল প্রাসাদটির (আমীরমহল) নিচ ও উপরতলা মিলিয়ে অজস্র ঘর ছিল। প্রাসাদের নিচের তলার জানালাবিহীন ঘরগুলির মধ্যে কিছু ঘর 'ষ্টোর রুম' হিসেবে এবং বাকি ঘরগুলিতে প্রাসাদের পরিচারিকা ও নবাব-বেগমদের ভৃত্যরা থাকতেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে দোতলার ঘরগুলি ছিল নবাব, বেগম ও তাঁদের সন্তানদের বসবাসের জন্য। দোতলার ঘরগুলির সামনে রয়েছে স্তম্ভ বিশিষ্ট লম্বা বারান্দা। প্রাসাদের দোতলায় প্রবেশ করার জন্য প্রাসাদের মাঝামাঝি অংশে বাইরের দিক থেকে দুটি প্যাচানো সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথমেই পড়বে বড় হল ঘর বা অডিয়েন্স রুম। অডিয়েন্স রুমের দুই পাশে রয়েছে প্রাসাদের বাকি ঘরগুলি। ঘরগুলির কোনটি ছোটো, আবার কোনোটি বিরাট বড়। দোতলার প্রতিটি ঘরই একটির সাথে অন্যটি দরজার মাধ্যমে সংযুক্ত। বিষয়টি এমনই যে প্রাসাদের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘরের মধ্যে দিয়েই অনায়াসে যাওয়া যাবে। প্রাসাদের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর বাগদাদী ছাদ। ছোটে নবাব সাহেবের থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাগদাদী ছাদ অনেকটা আর্চের মতো হয়ে থাকে তবে এই ছাদ তৈরিতে কোনো রকমের লোহা বা রডের প্রয়োজন হয়না। ছাদ তৈরির ইট গুলির মধ্যে দুটো ফুটো থাকে যার মধ্যে দিয়ে গাঁথনির মসলা অর্থাৎ তৎকালীন সময়ে চুন সুড়কি দিয়ে একটি ইটের সাথে আর একটি ইট লাগিয়ে এই বিশেষ ধরনের ছাদ নির্মাণ করা হতো।

নবাবি আমলে আমীরমহলের জৌলুশ ছিল দেখার মত। ভাগীরথী নদী তীরে মনোরম পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছিল এই প্রাসাদ। সিঁড়ি থেকে মেঝে সব কিছুই মোড়া ছিল বিদেশী টাইলসে। ঘরগুলি সাজানো ছিল বহুমূল্য আসবাবপত্রে। ঘরের ভেতরে দরজায় লাগানো থাকতো দামী কাপড়ের কারুকার্যখচিত পর্দা। প্রাসাদে প্রায় সন্ধ্যায় নাচ গানের আসর বসতো। আমীর মহলের সামনে একটি উঁচু সিঁড়ি রয়েছে। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে জানা যায় এই সিঁড়িটি বেগমরা হাতীর পিঠের হাওদাতে ওঠার জন্য ব্যবহার করতেন।

নিজামত পরিবারের সদস্যদের মতে, বড়ে কোঠি বা হাজারদুয়ারী প্রাসাদ নবাব হুমায়ুন জা বালাখানা বা আমীরমহল নির্মাণের পর তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেই নতুন প্রাসাদ নবাবের মনমতো হয়নি। কারণ সেখানে বেগমদের জন্য কোনো খোলা মেলা জায়গা ছিল না, যেখানে তাঁরা প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে পারতেন। তাছাড়া নতুন প্রাসাদে তাঁদের যথেষ্ট আব্রুও রক্ষিত হবে না মনে করেই হয়ত নবাব তাঁর পরিবার সহ একরাতের বেশি বড়ে কোঠী বা হাজারদুয়ারীতে থাকেননি। অবশেষে তিনি আমীর মহলেই ফিরে আসেন এবং বাকি জীবন এই প্রসাদেই অতিবাহিত করেন। যদিও ইতিমধ্যেই নবাব হুমায়ুন জা কেল্লা নিজামত থেকে কয়েক কি.মি. দূরে ফিন্ডেলবাগে কিছু জায়গা ও বাড়ি কিনেছিলেন এবং সেখানেও তিনি মোতি মহল বা লালবাংলো নামে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। তখন থেকেই সেই এলাকাটি নবাবের নামে মোবারক মঞ্জিল বা হুমায়ূন মঞ্জিল নামে পরিচিত হয়। তবে নবাব হুমায়ুন জা সেখানে মাঝে মধ্যে থাকলেও আমীরমহলই ছিল তাঁর আসল বাসস্থান।

শুধুমাত্র নবাব হুমায়ুন জা-ই নন, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের নবাব যেমন নবাব ফেরাদুন জা, হাসান আলি মির্জা, এবং নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জাও এই প্রাসাদে বসবাস করেছেন। আজও হাজারদুয়ারীতে গেলে দেখা যায় আমীরমহলের দোতলার কোনো এক ঘরে দাঁড়ানো নবাব ফেরাদুন জা'র বিশাল আকৃতির ছবি।

ওয়াসিফ আলি মির্জা নবাব হওয়ার পর বহু অর্থ কষ্ট থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাসাদ ছিল— চমন মহল, বেগম মহল, সোনামহল, মোতি মহল প্রভৃতি। নতুন প্রাসাদ নির্মাণ হওয়ার ফলে জরাজীর্ণ আমীরমহল সংস্কার করে সেখানে বসবাস করার কথা কেউই ভাবেননি। ফলে তখন থেকেই আমীরমহল ক্রমশ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতে থাকে।'
.
.
.
সুপ্রকাশ অঞ্চলচর্চা গ্রন্থমালা ৯
............................................

মুর্শিদাবাদের নবাবি কেল্লার কথা
ফারুক আবদুল্লাহ

প্রচ্ছদের ছবি : রবার্ট স্মিথ (১৮১৪)

মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।