এক যে ছিল গ্রাম। বাগাল গুরুর পাঠশালা

পাঠশালায় বড়ো পনশয়-এর ভয়টা অন্য পড়ুয়াদের মতো আমার বুকেও অনেকদিন চেপে বসেছিল সেই সময় দৈবাৎ একদিন অন্য একটা পাঠশালার সন্ধান পেয়ে গেলাম

আমাদের বাগাল বদনাকে দেখতাম রোজ সকালে আমদের বাড়ির গরু-মোষ নিয়ে বেরিয়ে যায় সে আমার থেকে এমন কিছু বড়ো নয়, অথচ তার কত মজা! ইস্কুলে যেতেই হয় না সারাদিন গরু-মোষ নিয়ে জঙ্গলের ধারে ঘুরে বেড়ায় এক সকালে আমি তার পিছু নিলাম বদনা বলল, – কুথায় যাবে?

আমি বললাম, – তোর সঙ্গে গরু চরাতে

বদনা খানিক ভাবল তারপর বলল, – এখন লয় বইদপ্তর লিয়ে ইস্কুলে বেরাবে তারপরে ইস্কুল না যেয়ে আমার থানে চলে আইসবে নাইলে গলা (মালিক)-রা জাইনতে পারবেক আর তুমাকে ধরে লিয়ে আসবেক

ভাবলাম ঠিকই তো! ইস্কুলে যায় না বলেই বদনার এতো বুদ্ধি! বইদপ্তর নিয়ে হাজির হলাম বদনার গোঠে সে আমাকে একটা কাড়া(পুরুষ মোষ)র পিঠে চাপিয়ে দিল বলল, – ইয়ার নাম কালী খুব শান্ত ছুটবেনি কখনও

খুব মিষ্টি স্বভাব কালীর ভীষণ ভাব হয়ে গেল তার সঙ্গে প্রায় সারাদিন তার পিঠেই থাকি দুপুরে তাকে খালের জলে নামাই সে জলে বসে পড়ে আমি খড়ের ছোবড়া দিয়ে ঘষে ঘষে তাকে পরিষ্কার করি কখনো কখনো লম্বা লম্বা কচি ঘাস ছিঁড়ে এনে তার মুখের সামনে ধরি সে তার খড়খড়ে জিভ দিয়ে আমার পিঠ চুলকে দেয় আমাদের বাড়ি থেকে বদনাকে জলখাবার দেয় জলখাবার মানে মুড়ি-লংকা-পেঁয়াজ সেই খাবার সে তার গামছায় বেঁধে নিয়ে আসে গামছা-বাঁধা মুড়ি খালের জলে ডুবিয়ে নরম করে তারপর সেও কালীর পিঠে চড়ে আমার মুখোমুখি বসে গামছা খোলে বলে, – ঠাকুর, তুমি চাট্টি খায়ে লাও আগে

আমি বলি, – তোরও তো ভোক লেগেছে, একসনেই খাই না কেনে

বদনা বলে, – তুমি বামুনছা, কে না কে দেখে ফেলবে, অমনি আমার পাপ লেগে যাবে

বটেই তো গামছার গন্ধ-লাগা ভেজা মুড়ি মুখে নিতেই অমৃতের আস্বাদ বাড়ির লোক খালি দুধ-মুড়ি খেতে দেয় কেন কে জানে! কি বিচ্ছিরি খেতে! বদনার কথা ভেবে অবাক হই এত কিছু সে বাগালি করে শিখেছে! দ্বিতীয় দিনে বদনা তার আশ্চর্যতম বিদ্যাটি প্রকাশ করল জঙ্গলে ঢুকে দুটো সোঁদাল পোকা ধরে আনল তারপর তাদের দুই হাঁটুর নীচের অংশ ভেঙে ফেলে সেই ফাঁপা জায়গায় দুটি সরু কাঠি ঢুকিয়ে দিল সেই কাঠি দুটি বাঁধা আছে একটি শক্ত লতার দুই প্রান্তে লতাটিকে এবার অন্য একটি মোটা কাঠির মধ্যে গলিয়ে দিল সে কাঠিটিকে দুহাতে ধরে লতাটিকে দুলিয়ে দিতেই সোঁদাল পোকা উড়তে শুরু করল আমি সম্মোহিত হয়ে গেলাম বনবন করে উড়ছে সোঁদাল, আসলে সে লতায় বাঁধা কাঠিটিকে ঘিরে গোল হয়ে পাক খেয়ে চলেছে তার ওড়ার বিনবিনে মিষ্টি আওয়াজ আর তার গোলাকার পথের সোনালি রেখা একই সঙ্গে কান ও চোখকে যেন মোহিত করে দিল বড়ো পনশয়ের দ্বিতীয় ভাগের বানান শিখলে বদনা যে কোনোদিন এমন আশ্চর্য কাণ্ড করতে পারত না সে-বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলাম

ইস্কুল ছুটির সময় হলেই আমি গাছতলা থেকে বইদপ্তর বগলে তুলে বাড়ি চলে আসি বদনা একটু পরে গরু-মোষ তাড়িয়ে নিয়ে গোয়ালে ঢোকে আমার নতুন ইস্কুলের কথা বদনা, কালীকাড়া আর আমার মধ্যেই লুকানো থাকে তিন দিনের দিন কালীকাড়ার এক আশ্চর্য রূপ দেখাল বদনা মুড়ি খাওয়া শেষ হতেই তার ইজেরের পকেট থেকে খানিকটা শুকনো দোক্তাপাতা বের করে কাঁচা শালপাতায় মুড়ে লম্বা বিড়ির মতো পাকাল এক এক করে তিনখানা দুটো তার দুই কানে গোঁজা, একটা হাতে ধরা জিনিসটা আমার চেনা, বড়োদের অনেকে খায় তাই বলে বদনাও খাবে! সে তো এখনও ইজের পরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, – তুই চুটি খাবি?

জবাব না দিয়ে বদনা দেশলাই বের করে হাতের চুটিতে আগুন ধরায় আমি অবাক হয়ে দেখি তার নাক থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে আমার অবাক হওয়া দেখে বদনা তার ডান কানের চুটি কান থেকে খুলে আমার হাতে দেয় তারপর আমাকে বলে, – একবার টানো, খুব সোজাতুমার নাক দিয়েও ধোঁয়া বেরাবে

আমি চুটি দুই ঠোঁটের মাঝে গুঁজি বদনা তাতে আগুন দেয় প্রথন টানেই দম আটকে যায় আমার কাশতে কাশতে গলা দিয়ে জল উঠে আসে বদনা আঁজলা ভরে খালের জল তুলে আমার মুখে মাথায় দেয় কালী একটু দূরে চরছিল আমি মুখ তুলে দেখি সে কখন চলে এসেছে আমাদের কাছে, বদনার সামনে দাঁড়িয়ে মাথাটা একবার নামাচ্ছে, একবার তুলছে আর ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করছে বদনা বলল, – দেখবে ঠাকুর মজাটা

বলেই সে নিজের নিভে যাওয়া চুটি ডান কানে গুঁজে বাঁ কানের চুটি জ্বালিয়ে কালীর মুখে গুঁজে দিল আমি হতভম্ব হয়ে দেখি কালী চোখ বুজে চুটি টানছে আর তার নাক দিয়ে বদনার মতোই গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে বদনা বলল, – আমার মনে লয় কি ঠাকুর তুমি কদিন ইস্কুলে যেয়েই কাহিল মেরে গেছ লেখাপড়া শিখলে আর চুটি টানার দম থাকেনি মানুষের দেখ না কেনে, আমি কুনোদিন ইস্কুলে যাইনি, কালীও যায়নি আমরা দুজন কী সুন্দর চুটি টাইনতে পারলম আর তুমি কেশেমেসে একশা হলে ইস্কুলে যাওয়ার বিপদ কি কম?

বেশ ভালোই চলছিল কালীকাড়ার পিঠে সওয়ারি হয়ে বদনার কাছে বিবিধ-পাঠ বাদ সাধল শেষে কিনা ওই কালীকাড়াই! সেদিন বদনার পাঠশালা থেকে বিকেলে বাড়ি ফিরে ভাত খেয়ে সবে উঠেছি, দেখি বদনা তার চরুয়াদের গোয়ালে ঢোকাচ্ছে আমাকে দেখে চুপিচুপি বলল, – একবার আটচালার দিকে যাও না কেনে, কারা সব এসছে সেখেনে, কালী উদিকেই পিচকে পালাল দেখতে পেলে লিয়ে আসবে আমি পিছুতে যাচ্ছি চললাম আটচালার দিকে গাঁয়ের দুর্গামণ্ডপের সামনে আটচালা পথে নিতাইদাদুর সঙ্গে দেখা বলল, – আটচালায় যাচ্ছু? এখন আর যেয়ে কী হবেক? টিউকলের মিটিন শেষ অফসার বাবুর সাইকেলটা দেখবি যদি তাড়াতাড়ি যা

সেখানে পৌঁছে দেখি পেন্টালুন-পরা অফিসার আটচালা থেকে নেমে পকেট থেকে সাদা মতন একটা জিনিস বের করে ঠোঁটে গুঁজলেন বিড়ির চাইতে লম্বা, চুটির চাইতে খাটো, পাতার বদলে কাগজ দিয়ে মোড়া বিদেশি দোক্তার সেই জিনিসটার নাম সিগরেট অনেক দাম গাঁয়ের লোক খায় না অফিসারের সাইকেলটি আটচালার একপাশে দাঁড়িয়ে সাইকেলটিকে ঘিরে গুচ্ছের ভিড় আমি শুধু তার হ্যন্ডেলটাই দেখতে পাচ্ছি সাইকেল তো চট করে দেখতে পাওয়া যায় না, আমি সেদিকেই এগোতে যাচ্ছিএমন সময় একটা পরিচিত আওয়াজে চমকে উঠলাম মুখ ফিরিয়ে দেখি, অফিসার সিগরেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন আর কালী কোথায় ছিল কে জানে, কখন তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে আর ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করছে আমিও মুখ ফিরিয়েছি, একই সঙ্গে অফিসারও পিছন ফিরেছেন যেই না কালীকে দেখা, অমনি তিনি সিগরেট হাতেই সামনের দিকে দৌড় লাগালেন তার পেছনে ছুটল কালী অগত্যা কালীর পিছনে আমিও অফিসার পড়িমরি করে ছুটছেন আমি নিমেষে বুঝে গেলাম তিনি বদনার ইস্কুলে পড়েননি, দ্বিতীয় ভাগের বানান মুখস্থ করে অফিসার হয়েছেন তাই ছুটতে ছুটতেই চিৎকার করে বললাম, – আপনার সিগরেটটা দ্যান আঁজ্ঞ্যা, দ্যান আঁজ্ঞ্যা!

কে শোনে কার কথা! তিনি ছুটছেন তো ছুটছেনই বাধ্য হয়ে আমি কালীকে টপকে অফিসারের কাছে তার হাত থেকে সিগরেট কেড়ে নিয়ে কালীর মুখে গুঁজে দিলাম নিমেষে শান্ত কালী, তার নাকের ফুটো দিয়ে গলগল করে বেরোচ্ছে সিগরেটের ধোঁয়া বেশিক্ষণ নেশা করা হল না বেচারার তার মুখের লালায় সিগরেট ভিজে নেতিয়ে গেল অফিসার ততক্ষণে থেমেছেন, হাঁপাতে হাঁপাতে পিছন ফিরে অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, – কালীর চুটির নেশা আঁজ্ঞ্যা তামুকের গন্ধ পেলে দু-টান দিতেই হবেক সিগরেট খেতে শিখে নাই তো

এক লাফে উঠে বসলাম কালীর পিঠে পায়ের চেটো দিয়ে তার পেটে ঠুকতে ঠুকতে বললাম, – চ চ ঘরে চকত চুটি খেতে পারুস দেইখব

গাঁসুদ্ধু লোকের সামনে কালীর সেই ভেলকি দেখানোর ফল হিসাবে আমার বাড়ির লোক চিরকালের মতো আমাকে বদনার ইস্কুল থেকে উৎখাত করে সেই বড়ো পনশয়ের কাছেই দাখিল করে দিলেন সেই বেদনা বহুকাল আমি পুষে রেখেছিলাম মনে গল্পের মতো করে সেই স্মৃতি বর্ণনা করলাম বলে এটাকে গল্প ভাববেন না কিছু অতিরঞ্জন যদি থাকে সেটা সেই বেদনার রেশটুকু চাপা দেওয়ার চেষ্টা মাত্র

.......................................

এক যে ছিল গ্রাম

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

.......................................

প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল

অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত


মুদ্রিত মূল্য : ৩২০ টাকা

সুপ্রকাশ



Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম। ডাকাতি

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।