আহাম্মকের খুদকুড়ো।। দুর্লভ সূত্রধর।।

‘সে-সময় বিদ্যুৎ দপ্তরের অফিসের পর থেকে মাহেশ্বরীতলা পর্যন্ত রাস্তাটা অত জমজমাট ছিল না। সদ্য ঘরবাড়ি দোকানপাট গড়ে উঠছিল—পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মানুষেরা এই অঞ্চলে সবে বসতি স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করছিলেন। পাশাপাশি দেশভাগের ভাগফলজনিত কারণে গজিয়ে ওঠা একাধিক কলোনি ছিল এমনই সব প্রবর্তিত বসতি। তখনও এই পল্লীগুলিতে ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। অঞ্চলটি তুলনামূলকভাবে নির্জন, পল্লীর পেছনের সীমানা দিয়ে রেললাইন, চারদিকে ঝোপঝাড়, সন্ধ্যার পরেই ঝুপসি অন্ধকার।

সেদিন গ্রীষ্মকাল, বিখ্যাত গা-জ্বালানো গরম দিদিরা ভেতরের বারান্দায় তাদের পড়ার জন্য বরাদ্দ লণ্ঠনের চারপাশ ঘিরে পাঠে এবং পড়ার নামে খুনসুটিতে মত্ত, দাদারাও দিদিদের কাছে বসে সুর করে কিশলয়ের ছড়া বলছে, আর আমি তাদের অনতি দূরে খালি গায়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছি। সহসা আমার কান্না এবং আমার দিকে মুখ করে বসে থাকা মেজদির প্রবল আর্তনাদ।—কিছু একটা আমার নাভি-সংলগ্ন কোমরের কাছে কামড়ে দিয়েছে! মেজদির মতে একটা বিরাট মাপের শিয়াল আমাকে কামড়ে মুখে করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল, ছোড়দির মতে জন্তুটা ছিল একটা বড়োসড়ো কুকুর, দাদার মতে সেটা শিয়াল বা কুকুর নয় অদ্ভুত দেখতে একটা জন্তু! কান্না আর চিৎকার শুনে ছুটে আসা প্রতিবেশীরা ছোড়দির বিবরণ শুনে ওটা শিয়াল বা কুকুর নয়, হায়না হতে পারে বলে রায় দিলেন। আমার কোমরের কাছে দাঁতের দাগ আর রক্তাক্ত ক্ষত দেখে এটা অন্তত বোঝা গেল জন্তুটা আর যাই হোক শ্রীনাথ বহুরূপী নয়—হিংস্র ও মাংসাশী কোনো শ্বাপদ।

এক্ষেত্রে পরিচিত জন্তু হওয়ায় শিয়ালটাই দাঁড়িয়ে গেল।

নবকুমারকে তো আর সত্যি সত্যি বাঘ বা শিয়ালে খায়নি, তিনি পড়েছিলেন কাপালিকের হাতে।

কাপালিকের হাতে না-পড়লেও এর পরের অধ্যায়ে গিয়ে পড়লাম ডাক্তারবাবুদের হাতে। মা নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। প্রথমে অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো ক্ষতস্থান। তার পর নাভির চারপাশে ইয়া মোটকা সূচ দিয়ে চৌদ্দটা ইঞ্জেকশন।

মাকে কী কষ্ট করে যে আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে লজেন্স-টজেন্সের মতো নিষিদ্ধ বস্তু দিয়ে ইঞ্জেকশন দিতে নিয়ে যেতে হতো।

এতদিনে চৌদ্দটা ইঞ্জেকশনের ব্যথা মিলিয়ে যাওয়ারই কথা ছিল।

কিন্তু মিলিয়ে যেতে পারল না। বেশ অনেকটা বড়ো বয়স পর্যন্ত যে বা যাঁরাই বাড়িতে আসতেন, সে দিদির বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়-স্বজন—আমাকে দেখলেই সকলে জিজ্ঞেস করতেন—’ও, তোমাকেই তো শিয়ালে কামড়ে দিয়েছিল?'

কেউ কেউ বলতেন—'ভাগ্যি ওটা শিয়াল ছিল, হায়না হলে কী যে হতো। ওদিকে তো শুনতে পাই ঝোপঝাড়ের মধ্যে সে-সময় দু-চারটে ছোটোখাটো বাঘ-টাঘও আছে, ভাগ্যি সেসব কিছু আসেনি!'

আমাদের ডুমাটোলার ছোটোদাদু শিয়াল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতেন। তিনি যৌবনে নাকি জলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর মতে সেকালে ডুমাটোলার আশপাশের শিয়ালরা নাকি ছিল বিখ্যাত ভিটরে পণ্ডিত। তাদের মতো চালাক শিয়াল নাকি ভূভারতে পাওয়া যেত না। তারা 'বড়ি সাফাইসে' গৃহস্থের দু-চারটে হাঁস-মুরগি-পায়রা নিয়ে যেত। কিন্তু কস্মিনকালেও মানুষকে তারা কামড়ায়নি।

দাদু পরে সবটা শুনে বলেছিলেন—'দেখো দাদুভাই, ভাগ্যি শিয়ালে কামড়েছিল। শিয়াল বলে বেঁচে গেছ। জরা সোচকে দেখো, চারপেয়ে জন্তুদের থাকার মধ্যে আছে দাঁত আর নখ। খিদে না পেলে কিংবা আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া তারা কাউকে আক্রমণ করে না। তারা ঝুটমুট কিসিকো নেহি কাটতে! তাদের তো আর নিত্য-নতুন দারুণ দারুণ নামের সব অস্তর-টস্তর নেই। লুকোনো কোনো ফন্দি-ফিকিরও নেই। তাই শেয়ালের কামড় ইত্‌না খরাব নেহি।'

আরও কী কী বলেছিলেন দাদু। তখন সেসবের অর্থভেদ করা হয়নি।

শেষে এমন হলো, সকলেই মেনে নিলেন যে, হিংস্রতর জন্তুর কামড় খাওয়ার থেকে শিয়ালে কামড়ানোটা একটা ভাগ্যের ব্যাপার।'

শিয়ালে কামড়ানোর এমন উদযাপন কদাপি দেখা যায়নি।

কিন্তু আহাম্মকদের ব্যাপারই আলাদা।’
.
.
.
.
আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : দুর্লভ সূত্রধর

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।