রহু চণ্ডালের হাড়।। অভিজিৎ সেন।।

"রাজমহল, বারহেট, তিনপাহাড়, সাহেবগঞ্জের হাটেবাজারে পীতেমের দল রঙিন কামিজ আর ঘাঘরা উড়িয়ে নতুন বিহ্বলতা আনে। মোষের শিঙে বাঁধা দড়ি দুপাশে বাঁশ দিয়ে ঠেলে টনটনা করা হয়। তার উপরে লম্বা বাঁশ হাতে যে রমণী চলে ফিরে আগুপিছু করে তার শরীর বড়ো টান টান, তার চোখমুখে আগুনে মসৃণতা, তার গায়ের চামড়া পাকা গমের রঙের। নিচের যে মানুষটা ঢোলক বাজায় তার মাথায় রঙিন ফেট্টি। আর একজন উপরআলির চলার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে বিচিত্র গান গায়, যে ভাষা কেউ বোঝে না, কিন্তু সুরের মাদকতা এড়াতে পারে না।
                                   মাধোয়া ধাইর্ যারে
                                   মাধোয়া ধাইর্ যারে 
                              ছোটি ছোটানি মাধোয়া ধাইর্ যা 
                              তিলেক্ পঢ়োরে তিলেক্ পঢ়োরে 
                              ছোটি ছোটানি মাধোয়া ধাইর্ যা 
                              হেরছি ফক্ড়িরে হেরছি ফক্ড়িরে 
                              ছোটি ছোটানি হেরছি ফক্ড়ি।
নতুন নতুন বসতি সব, নতুন নতুন মানুষ, উঠতি বড়োলোক, জাঁকজমক, ঠাট, সবই নতুন। বাজিকর ভাবে, হ্যাঁ, এমন জায়গাই বাজিকরের উপযুক্ত বটে। সাহেব, পুলিশ, মুন্সি, মহাজন, শুঁড়ি, কয়াল, দোকানদার, মোদক, দালাল সব মিলে একটা ব্যাপক লুঠের বন্দোবস্ত। প্রথমে বোঝা যায় না কে লুঠ করে আর কে লুঠ হয়। এ ভারি মজার ব্যাপার। যে লুঠ করে তার উল্লাস বোঝা যায়। কিন্তু যে মানুষটা লুঠ হচ্ছে সে কেমন করে দিনের শেষে শুঁড়ির দোকানে হুল্লোড় করে? মোরগা-লড়াইয়ে বাজি রাখে হাটে আনা শেষ সম্বল?
পীতেম বলে, বাজিকরের বেটারা, চোখ কান খোলা রেখে চলো। দেখেবুঝে চলো। পয়সা তোমাদের হাতে আসবে। দুঃখ তোমাদের ঘুচবে।
হাটের মাঝখানে বাজিকর খেলোয়াড়ের খেলার আসর যখন জমে ওঠে তখন পীতেম তার কিছু লোককে ছড়িয়ে দেয় হাটের মধ্যে। তারা নানারকম মনোহারি জিনিস বিক্রি করে অবিশ্বাস্য বিনিময়-মাধ্যমে। একটা রঙিন পুঁতির মালার বদলে একঝুড়ি চাল পাওয়া যায়, একখানা গালার চিরুনিতে পাওয়া যায় পাঁচ সের সরষে, নেশার জিনিসের বদলে সর্বস্ব দিতেও মানুষ রাজি থাকে।
এসব দেয় কারা? এসব দেয় যারা দূর দূর গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে অথবা পিঠের বাঁকে শসা নিয়ে আসে। যাদের কাঁখে গোঁজা একটি বাঁশি অবশ্যই হাত খালি হওয়ার অপেক্ষায় থাকে, যখন সে সমস্ত গ্লানি এবং শ্রমকে ভুলে সেই বাঁশিতে ফুঁ দেয়।"
.
.
.
রহু চণ্ডালের হাড়
অভিজিৎ সেন
.
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : শুভেন্দু সরকার
.
মুদ্রিত মূল্য : ২৯৫ টাকা 

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।