কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে রাখা আছে। সাগর এসে বসল, ব্যাগ থেকে ম্যান্ডোলিন বের করে গলায় ঝুলিয়ে নিল। টুংটাং আওয়াজ তুলে বলল, আগে একটা তুলসি দাসীর গান হয়ে যাক। অনেকদিন শুনিনি।

হাসে তুলসি, আপনার গান শোনার জন্যেই বসে আছি। আমার গান না হয় পরে হবে খন।

দরজার কাছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল বোষ্টমী। ওভাবেই বলল, গা না তুলসি। উনি যখন বলছেন।

— হ্যাঁ, গাও, উনার গান তো আছেই। —সুরেন গোঁসাইও দোহার হলো বোষ্টমীর।

—কী গাই বলতো! চিন্তিত মনে হলো তুলসিকে। কলকাতার মান্যিগন্যি গাইয়ে, তার সামনে তো আর যে সে গান গাওয়া যায় না।

মুশকিল আসান করল সাগর বোস। বলল, পদাবলির একটু অংশ গাও, তাতেই হবে। তোমার গান শুনলে এনার্জি পাবো।

হাসে তুলসি। আড় চোখে চেয়ে বলে, মরি আর কী। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে গান ধরল তুলসি—

এক কর্ণ বলে আমি কৃষ্ণ নাম শুনিব
আরেক কর্ণ বলে আমি বধির হয়ে রব।
ও নাম, শুনবো না শুনবো না।
নিলাজ বধূর নাম আমি শুনবো না, শুনবো না—আ— আ—

শেষের লাইন দুটি তুলসির সঙ্গে সকলে ধরল। সাগর, সুরেন গোঁসাই, গোঁসাইমা সকলেই এখন দোহার। রাফায়েল প্রথমটা বুঝে নিল। পরের  অংশে সেও গলা মেলাল। সাগর মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে উৎসাহ দিল। গান থামতেই সাগর বলে উঠল। বলেছিলাম না, তোমার গান শুনলেই এনার্জি পাই।

তুলসি মাথা নিচু করে হাসল। রাফায়েলের মনে হলো, যে কদিন দেখছে, মুখে সবসময় খই ফোটে। তারও লজ্জা হয়! সে বলল, এবার আপনি।

—হ্যাঁ, গাইবো।

হাতের ঘড়ি দেখল। ম্যান্ডোলিনে টুংটাং করে বলল, খান দুয়েক গাই। আবার যেতে হবে। আজ একটা লালনের গান শোনাই। সবই রাফায়েলের জন্যে। সে তার স্বভাবকণ্ঠেই ধরল—

মিলন হবে কতদিনে
আমার মনের মানুষেরও মনে।

সুরেন গোঁসাইও গলা মেলাল। তুলসিও। মাঝে মাঝে রাফায়েল বেশ আনন্দ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এতদিনে বোধ হয় বুকের ভিতর খুশির স্রোত বইছে। একটা চাপা পাথর নেমে যাচ্ছে। গান শেষ হতেই সুরেন গোঁসাই বলল, তোমার এই গান শোনার জন্যই তো বছর বছর বসে থাকি বাবাজী।

হাসে সাগর। বলে, এবার একটা প্রাচীন লোকগীতি গাইছি। এটা দ্বিজভূষণের লেখা। গোঁসাইজী গানটা জানেন।

গান ধরল সাগর—

কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে মন রে
ও মন রে—

গান থামিয়ে বলল, ও মন রে এই গানটা অনেকেই গায়। অনেক বাউল- ফকিরও গায়। গানের মধ্যে কীর্তনের একটা চলন আছে, এক বিখ্যাত বাউল এটা মাঝখান থেকে গেয়েছিল। সেইভাবেই বেশিরভাগ গায়ক গেয়ে থাকে। আমি যেভাবে গাই, সেইভাবেই গাইছি—

কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে মন রে
ও মন রে—

কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে
আমরা পেয়েছি ভাই মানব জনম
এ জনম চলে গেলে, এ জনম চলে গেলে
আর পাবো না। 
তাই হৃদ মাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না।
ও ছেড়ে দিলে, সোনার গৌর
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌর
আমরা আর পাবো না, আর পাবো না।
তোমায় হৃদমাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না।

তন্ময় হয়ে গেল সকলে। পিন পড়ার শব্দও বোধ হয় শোনা যাবে। সুরেন গোঁসাই তদগত চিত্তে ওপরের দিকে তাকিয়ে বলে, ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর পাবো না। বুঝলে বাবাজী, এ গান আমিও গাই। বাজার চলতি সুর আর চলনেই গাই। কিন্তু তোমার গানে যেন রস উথলে উঠল বাবাজী।

—আমি যেভাবে গাই সেইভাবেই গাইলাম। এবার যে গানটা শোনাবো, সেটাও সকলের জানা। গোঁসাইজীও গানটা গায়। আমি অর্ধেক গাইব, বাকি অর্ধেক রবীন্দ্রনাথের গান। একই সুরে দুটো গান। গাইছি—

দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা 

গানটি গাইতে গাইতেই সাগর ধরল—

ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।

অবাক হয়ে গেল রাফায়েল। ভাবল, আরে এই সুরে তো আমিও যিশুর গান লিখতে পারি। গান শেষ করে সাগর বলল, গানটা রাফায়েলের জন্যে। আজ উঠি। সন্ধ্যের আগেই রওনা দিতে হবে।


কীর্তনীয়া
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।