সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

দোমোহানি জায়গাটা পুরোনো, ইংরেজ আমলে রেল কোম্পানির ঘাঁটি, ইটের পুরোনো বাড়িঘর এখনও দু-একটা দেখতে পাওয়া যায়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানতেন, দোমোহানি জায়গাটাতে যারা থাকে, তারা সবাই মানুষ নয়, তাদের গা থেকে সন্দেহজনক গন্ধ ছড়ায়। সেই পুরোনো ভূতুড়ে দোমোহানি পুরো ডুবে গিয়েছিল, শোনা যেত, সেখানে শুশুকেরা সাঁতার দিচ্ছে। ঊনসত্তরের গোড়ায় জলপাইগুড়ি গিয়ে দেখি বাড়িতে বাড়িতে বাইরের দেয়ালে পলি জমাট হয়ে আছে তখনও, শহরের বাসিন্দাদের মন থেকে তিস্তার ভয় তখনও শুকোয়নি। সবাই বলছেন, কী করে বাঁধ ভেঙে মুহূর্তে ধেয়ে এসেছিলো পাগলা জল। তিস্তা তো বটেই, এমন-কী করলার মতো নিরীহ শান্ত নদীও ক্ষেপে গিয়েছিল। দেয়ালে পলির দাগ বহুদিন অবধি পড়া যেত।

আটষট্টির আগে পঞ্চাশের বন্যা, ভূমিকম্প। আমার বাবা সেসময় কি তার আগে থেকেই এ অঞ্চলের বাসিন্দা, তাঁর কাছ থেকে গল্প শুনতাম কালিম্পঙ যাওয়ার ছোটো রেলগাড়ির। তিস্তার জল ছুঁয়েই প্রায় সে গাড়ির লাইন শিলিগুড়ি থেকে গেইলখোলা অবধি যেতো। গেইলখোলার আগের স্টেশন রিয়াং। মংপু যেতে হলে সেখানে নামতে হতো। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রিয়াং স্টেশনে নেমেছিলেন বারকয়েক, সে গল্প মৈত্রেয়ী দেবীর লেখায় পাওয়া যায়। তার কিছু পরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এক বিদেশিনী তাঁর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে রিয়াং অবধি এসেছিলেন। সেখান থেকে তিস্তা ভ্যালি রোড হয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন রংলি রংলিওট চা বাগানে। সে বাগানের এক বাংলোয় এক বছর নির্জনবাসের অপূর্ব চিত্রময় বর্ণনা লিখে গেছেন রুমার গডেন, সেই বিস্মৃত বিদেশিনী। অধুনা বিস্মৃত, কিন্তু এক সময়ে তাঁর খ্যাতি ছিল—তাঁর লেখা নদী উপন্যাস নিয়ে ছবি করেন বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক জাঁ রেনোয়া। ব্ল্যাক নার্শিশাস নামের অন্য এক লেখা নিয়ে কাজ করেন ব্রিটিশ পরিচালক মাইকেল পাওয়েল। 'নদী' ছবির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন বাংলার প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্বরা। 'চলচ্চিত্র' বলে যে চমৎকার পত্রিকাটি কলকাতা সিনে সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হতো, যাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত প্রমুখ, সেখানে এই ছবি বিষয়ে বিস্তারিত খবর ছিল।

তিস্তা এবং তার চারপাশের পাহাড়-বন-চা বাগান নিয়ে যে ছোট্ট লেখাটা রুমার লিখেছিলেন, সম্প্রতি 'রংলি রংলিওট' নামে তা পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। এরকম বই আচমকা পেয়ে গেলে বড় আনন্দ হয়। বিশেষ করে তিস্তা নিয়ে রুমারের যে বর্ণনা, তার তুলনা মেলা ভার। পড়ে মনে হলো, আরে! ঋতুতে ঋতুতে তিস্তার জলের যে রঙ বদলের কথা বলেছেন রুমার, সে তো আমিও দেখেছি কতবার। বর্ষায় যে ধূসর কাদাভরা স্রোত ক্রুদ্ধ গর্জনে বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়, পুরোনো পাথরের ফাঁকে ফাঁকে যে ঘূর্ণি মাথা গুলোনো পাক খেতে খেতে বলে খবরদার, শীতে তা নিতান্তই শান্ত, বন্ধুসুলভ, সবুজ স্বচ্ছ জলের তলায় পাথরনুড়ি স্পষ্ট দেখা যায়, রূপালি-সাদা বালির চরায় শুয়ে থাকা যায়। শীত যত যাবে, নদী রঙ বদলাবে, সবুজ থেকে নীলচে হয়ে উঠবে, শীর্ণ হয়ে আসবে ধারা। যে অসংখ্য উপনদী আর ঝর্ণা দূর পাহাড়ের বৃষ্টিভার তিস্তায় এসে ঢালে, গ্রীষ্মে তারা প্রায় জলহীন। বর্ষা এলে আবার সজীব হয়ে উঠবে তারা, তিস্তাও রূপ বদলাবে।

এখন মনে হয়, এসবই অনেক আগের, অন্য সময়ের কথা। থমকে খুঁড়িয়ে হলেও এখনও ঋতু বদল হয়, বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত গ্রীষ্ম আসে। জলের রঙ সম্ভবত এখনও বদলায়। কিন্তু নদীটাই তো আর নেই। সিকিমের উত্তুঙ্গ গিরিশিখরে ঘেরা হিমবাহ থেকে বেরিয়ে তিস্তার গভীর খাত সেভকে এসে সমতলে নামে। গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে সেই খাতের উপর অন্তত গোটা পাঁচেক বাঁধ পড়েছে। আরো অনেকগুলো হবার কথা। নদীর দু-ধারে পাহাড় ভেঙে গুঁড়িয়ে দৈত্যাকার হলুদ যন্ত্র চলছে দিনরাত। বাঁধ, নতুন রাস্তা, রেলপথ। খালি হয়ে যাচ্ছে জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি ঢাল, পাহাড়চূড়ো। বন নেই বলে ধস নামছে বেশি, যখন তখন। বুজে যাচ্ছে নদীঝর্ণার উৎসমুখ। বরফ-গলা যে জলে তিস্তার মূল প্রবাহের পুষ্টি, তা এখন বাঁধা পড়া, খণ্ড খণ্ড ছোটো ছোটো নদী। বাঁধ দিলে পুরোনো নদী মরে যায়। বাঁধ পরবর্তী যে হীনবল দুঃখী ধারা, তা অন্য নদী, তার চরিত্র ধরণধারণ কোনোটাই আগের মতো নয়। তিস্তার পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীচরিত্র বুঝিয়েছিলেন ভূতত্ত্ববিদ দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়। কালিম্পঙ যাবার পথে সেভক থেকে তিস্তাবাজারের মধ্যে যে দুটো বাঁধ এখন পুরো তৈরি হয়ে গেছে, তার প্রথমটার, পুরোনো রিয়াং স্টেশনের কাছে তিস্তা ভ্যালি রোডের ঠিক নীচে ২৭ মাইলের বাঁধের কাজ তখন শুরু হয়ে গেছে। চেষ্টা করা হচ্ছিল, যদি পরেরটা, অর্থাৎ কালিঝোরারটা আটকানো যায়। পারা গেলো না। সরকার, ঠিকাদার, এবং স্থানীয় তোলাবাজ পাহাড়ি দাদা, এ মিলিয়ে যে বিস্ফোরক শক্তি তৈরি হলো, নদী ও নদীপন্থীরা সে তুলনায় নস্যি। যখন ইচ্ছে, এক নদী ভেঙে দশটা নদী তারা করবেন। সে গুড়ে বালি দেয় কার এত দুঃসাহস!
.
.
.
সময় ভ্রমণ
দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা
সৌমিত্র ঘোষ

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী 
অলংকরণ : শুভশ্রী দাস, অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৫৬০ টাকা

সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।