হাফ প্যাডেলের কাল।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর বই 'হাফ প্যাডেলের কাল' পড়ে লিখেছেন অর্ণব বসু। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
........................................

আমরা যারা নিতান্ত মফস্বলের ছেলে মেয়ে, আমাদের সকলেরই একটা হাফ প্যাডেলের কাল ছিল! রঙচটা, ভেঙে যাওয়া সাইকেল জানে সে সব আত্মগোপনকথা। চোখে তখন একটু একটু করে রোদের আলো ফুটছে, আমরা দেখছি দুহাজার সাল পেরিয়ে আসা বিশ্বের রঙরূপ কীভাবে পালটে যাচ্ছে কালের সীমায়! নব্বই দশকের মালেনা সিনেমা দেখে মনে হয়েছিল, এই তো আমাদের জীবন, 'সাইকেলচারীর আত্মকথা', দু চাকায় বিশ্বভ্রমণ! 

ছোটো ছোটো মফস্বল একটু একটু করে ঝুঁকে পড়ছে শহরের দিকে! লড়ঝড়ে সাইকেলের দিন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে, কংক্রীটের স্বভাব বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে আমাদের কমিউনিকেশনের পদ্ধতি, এমন একটা অদ্ভুত সময়ে আমরা বড় হচ্ছিলাম। অর্থাৎ দুহাজার সাল পরবর্তী।  বড় হওয়া বলতে দীর্ঘ বালকজীবন পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ। কিন্তু কেমন ছিল ষাট বছর আগে দুর্গাপুরের আধা গ্রাম আধা শহরে কোনো একজন বালকের ক্রমশ বড় হওয়ার জীবন! পাড়া আর গাঁয়ের মধ্যে আজকাল প্রকৃতিগত তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না। গাঁয়ের মানুষজন গা ঢাকা দিয়েছেন কবেই!

লেখক অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর "হাফ প্যাডেলের কাল" বইটি পড়তে পড়তে মনে হল, যেন সেইসব পাড়া-গাঁ-জঙ্গল-মানুষের মধ্যে দিয়ে সমস্ত শরীর নিয়ে হেঁটে চলেছি অনায়াসে! লেখকের ভাষায়, "শক্ত লাল মাটিতে বেঁটে বেঁটে শাল।" 

কিশোরবেলায় প্রবেশের আগে দীর্ঘ বালকজীবনে আমাদের ছুঁয়ে থাকে সবুজ-লাল-নীল আলো! সেসব আলোর মধ্যে থেকে উঠে আসে অফুরান স্বপ্ন আর জিজ্ঞাসা! মনের অপেরায় কত মানুষের আসা যাওয়া চলতে থাকে, চলতেই থাকে! আমাদের কৌতুহলের ভাঁড়ার যেন এক জীবনেও ফুরায় না! লেখকের বালকবেলার শুরু প্রকৃতির হাত ধরে, সে কারণেই বুঝি গোটা বই জুড়ে সবুজ প্রাণের সঞ্চার করে গেছেন তিনি। টুকরো টুকরো ঘটনায় লেখকের সাথে সাথে কখন যে আমরা ছোট থেকে একটু একটু করে বড় হচ্ছি, তা টের পাইনি। 

আমাদের সকলের জীবনেই যেমন একজন ভোলানাথ থাকে, যার ব্যবহার করা শব্দের প্রতি, আচরণের প্রতি আমাদের অফুরান কৌতুহল। বালকের স্কুলজীবনেও এমন একজন ভোলানাথ আসে। তাঁর সাথে ছিল নিভৃতে, মনের মধ্যে, শব্দের নাড়াচাড়া! বালকের শিক্ষার বেশিরভাগ কেটেছে প্রকৃতির সান্নিধ্যে, গাছে আর জলে! স্কুলের যাওয়ার পর থেকে একটু একটু করে বালকপ্রাপ্তির আলো প্রবেশ করে তাঁর জীবনে। বালকের ভাষায়, থুড়ি লেখকের ভাষায়- "হাফ-প্যাডেলে ভর দিয়ে বাতাস কেটে এগিয়ে চলা ছাড়া আরও যা কিছু সে শিখল তার কিছু রইল তার দুটো খাতার মধ্যে, বাকিটা তার মাথায় অথবা বুকের গভীরে।"

ফুলপ্যান্ট পরার প্রতি আমাদের এক অসীম টান ছেলেবেলা থেকেই! বালক জানত, পরীক্ষা শেষ হলেই আরেকটু বড় হবে আর ফুলপ্যান্ট পরবে।

গোটা বইতে স্বাভাবিকভাবেই লেখকের স্কুলজীবনের অনেকখানি কথা উঠে এসেছে। স্কুলের শিক্ষকদের কথা, ছাত্রদের শাস্তি দেওয়ার নানা উপায়, বালকের মার্কশিট নিয়ে গর্বের সাথে বাড়ি ফেরা, স্কুলের ম্যাগাজিনে ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা প্রকাশের আনন্দ, লাইব্রেরি থেকে আনা বড়দের জন্যে লেখা সাহিত্যের বইপাঠ — উঠে এসেছে সবই!

লেখকের এই আত্মচরিত আসলে আমাদের সকলের নিজস্ব একটা জার্নি! জীবনের প্যাডেলে আরেকবার পা দেওয়া, চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন বালক! বয়:সন্ধি পেরোতে পেরোতে যৌন কৌতুহল, ঝমঝম শরীর, যেন শরীরের ভেতর দিয়ে মেল ট্রেন ছুটছে, সহসা গড়ে ওঠা ভয়, সব মিলিয়ে কিশোরবয়সের এক সাধারণ অথচ অকপট জীবনযাত্রা তুলে ধরেছেন লেখক। 

লেখায় উঠে এসেছে বাংলার কিছু আচার, গোস্বামী বাড়ির বিবিধ বিচিত্র নিয়ম, পারিবারিক টানাপোড়েন, দিদিগোঁসাইয়ের মৃত্যু, গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা এক বালকের জীবনমানচিত্র। যেখানে এসেছে বালকের ভাষায় পবিত্র প্রেম, কুয়োতলা, ভূগোলে পড়া আগ্নেয়গিরির লাভা বিস্ফোরণ, ঘামে ভিজে যাওয়া ফ্রক, বিবেকের কাছে অপরাধময় এক জগত। 

শীতের দুপুরে এই বই ক্রমশ নিয়ে যায় ফুরফুরে স্মৃতিময় সামান্য বিষাদঘেরা এক বালকবেলায়! তবে এই বই পড়তে পড়তে বয়স্ক বালিকাদেরও কোথাও কোনো সমস্যা হবে না! আসলে ছেলেবেলায় বালক-বালিকার মধ্যে বিশেষ তফাৎ বুঝে ওঠার আগেই বইটি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্মৃতির বেড়াজালে! সাইকেলে প্যাডেল করতে করতে বালক পেরিয়ে যাচ্ছে একটা জীবন, যে জীবন পাতাদের সখ্যে উঠে এসেছে এত বছর পর! স্মৃতি খুঁড়ে, জমাট আখ্যানে সেসব গল্পের অংশীদার হয়ে যাই আমরাও! বাংলা সাহিত্যে বহুদিন এ ধরণের আত্মকথা পড়িনি বা চোখে পড়েনি! প্রখ্যাত সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেছিলেন, "লেখা উঠে আসে গ্রাম থেকে, শহর থেকে নয়।" এই বই পড়লে এই কথা বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কতখানি সত্য, তা আরও কিছুটা টের পাওয়া যায়।

বইটি একটি দ্বিতীয় খন্ড দাবী করে, কারণ লেখকের আত্মকথা এখনও বালক বয়সেই আটকে রইল! কিন্তু লেখক তো বৃদ্ধ হয়েছেন, হয়েছেন কী? লেখক হয়ত বালকই আছেন, শুধু পিঠের ওপরে কতকগুলো সংখ্যা বেড়েছে কেবল! তবুও বালক থেকে প্রকৃত আলোকে আসার বাকি গল্প দুই মলাটে দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

লেখার অনেকখানি যে মানুষকে কেন্দ্র করে, সেই গোস্বামীবাবুর মৃত্যু, সাইকেলে ফুল প্যাডেল করে দ্রুত ইনজেকশন নিয়ে আসার প্রাণপ্রাণ চেষ্টা এক ধাক্কায় যেন অনেকখানি বড় করে দেয় বালককে! দ্বিতীয়বার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া বালকের জীবন আটকে যায় জলহীন চোখের অন্তরালে! নোনা জলের ধারায় ভেসে যায় বালক, ক্লান্ত পা আরো খানিক ক্লান্ত হয়ে আসে, বালক জানেনা, শ্মশানে কি নিয়ে চলে গেছে দাদাকে? মৃত্যু তাঁকে নির্লিপ্ত করে, মৃত্যু তাঁকে জীবন চেনায়, এক ধাক্কায় আকাশসমান বড় করে দেয়!

"একটা কালখন্ড ভেসে গেল এক বালকের মননে অকাল ভাঙচুরের চিহ্ন মাখিয়ে দিয়ে।"

বইটির পাঠ শেষে আমারও বুকে-মনে এই চিহ্ন রয়ে গেলো আজীবনের মত।

▪হাফ প্যাডেলের কাল
▪অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
▪মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
▪সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।