কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

বাবা নিরু বিশ্বাস তাকে নিজেদের দলের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। বাবা পরম্পরার কথা বলত। বংশ পরাম্পরায় দলকে ধরে রাখা, চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। নিরু বিশ্বাসের পর ছেলে রাফায়েল বিশ্বাস দল ধরে রেখেছে। কিন্তু তারপর? সব শূন্য। রাফায়েল ঘর বাঁধেনি। আর বাঁধবে কবে? বয়স গড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছে। যাদবেরও ছেলে নেই যে, তাকে শিখিয়ে কাঁধে দল তুলে দেবে। তার মেয়ে। বড় হয়ে যাবে একদিন। বিয়ে হয়ে যাবে। অন্য সংসারে চলে যাবে। তার হাতে দল দেওয়া মানে কি পরম্পরা রক্ষা করা? জানে না রাফায়েল। তার শ্বশুরবাড়ি যদি মেনে না নেয়? বরং তাকে গানের স্কুলে পাঠালেই ভালো হয়। গান শিখে নিজের মতো গাইতে পারবে। রাফায়েল চলে গেলেও নিরু বিশ্বাসের দলও শেষ হয়ে যাবে। শুধু লোকের মুখে মুখে থাকবে। তারপর একদিন ভুলেও যাবে।

মনটা বিষন্ন হয়ে যায় রাফায়েলের। এই বিষন্নতা নিয়েই সে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বাড়ির কাছে আসতেই শুনতে পায় হারমোনিয়ামের সুর। অপটু হাতে বাজাচ্ছে কেউ। আরও কাছে, দরজায় দাঁড়িয়ে সে শুনল, যাদবের মেয়ে রুমকি গাইছে কচি কন্ঠে। কিন্তু হারমোনিয়াম?

সে চুপিচুপি বাড়ির ভিতর ঢুকল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, খাটের উপর হারমোনিয়াম। তার গানের খাতাগুলো পাশে রাখা। তার মনে পড়ল, সে বেরোবোর আগে খাটে বসে একটা নতুন গান তুলছিল। সেই অবস্থাতেই সব রেখে বের হয়। ভেবেছিল, ফিরে এসে আসর বসাবে। তার অনুপস্থিতিতে রুমকি বসে পড়েছে। সে হেসে ফেলল। খুশিও হলো। পা টিপে টিপে রুমকির পিছনে এসে দাঁড়াল। রাফায়েলের গানের খাতা খুলে হারমোনিয়ামে নিজের মতো আঙুল বুলিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে। সে পিছন থেকে এসে রুমকির কাঁধে হাত রাখল। চমকে পিছন ফিরে জ্যেঠুকে দেখে এক গাল হেসে বলল, সব গান আমি গাইতে পারি।

—তাই?

রাফায়েল তাকে কোলে তুলে নিয়ে, তার গালে আলতো চুমো দিয়ে বলে, তুইই হবি আমাদের পরম্পরা।

গির্জার ঘড়িতে তখন সময় জানান দিচ্ছে সুমিষ্ট ধ্বনিতে। বাজছে ঘণ্টা। রাফায়েলের মনে হলো চাঁদের আলো ভেদ করে ভেসে আসছে বৃন্দগান 'শোন স্বর্গদূতের রব'। রুমকিকে কোলে নিয়েই সে দেওয়ালে ঝোলানো যিশুর ছবির দিকে এগিয়ে যায়। তার চোখের কোল দিয়ে উষ্ণ অশ্রু বেয়ে যায় গাল বরাবর। সে ছবির ওপর মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নির্বাক।
.
.
কীর্তনীয়া
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ২৮০ টাকা

সুপ্রকাশ



Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।